জাতীয় লিগের চতুর্থ রাউন্ড খেলে লাল বলের ক্রিকেটকে বিদায় বলার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। খুলনা বিভাগের এই ব্যাটারকে মাঠে নামার সময় গার্ড অফ অনার দেওয়া হয় কয়েক দফা। সোমবার ম্যাচ শেষে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করেছেন ইমরুল। বাউন্ডারি লাইনে দলের ফটোসেশনে শামিল হন বোর্ডের কর্তা ও জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটাররা। এভাবেই বিদায় জানানো হলো বাংলাদেশের অন্যতম সফল এই ক্রিকেটারকে। এমন স্মরণীয় বিদায় এর আগে বাংলাদেশের কোনও ক্রিকেটার পাননি। মাঠের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ইমরুল। সেখানে উঠে আসে নানা কথা। লাল বলের ক্রিকেট ছাড়লেও সাদা বলে আরও কিছুদিন খেলতে চান তিনি। বিশেষ করে জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডেতে ফেরার তীব্র বাসনা ইমরুলের মনে। যদিও বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টি অবাস্তব, তবুও তার লক্ষ্য এমনই।
ক্যারিয়ারের এই সময়টাতে এসে আপনার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ঠিক কতখানি?
ইমরুল: ২০০৬ সালে যখন আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়, আমি চিন্তা করিনি যে বাংলাদেশ দলের হয়ে এতগুলো টেস্ট খেলতে পারবো। আর সব শেষে এখন যেভাবে বিদায় নিলাম, আমি খুব খুশি যে বাংলাদেশের হয়ে ৩৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলতে পেরেছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। কারণ এক টেস্ট হোক, পঞ্চাশ কিংবা একশ, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাই বড়। প্রায় ১০-১২ বছর দলের সঙ্গে থেকেছি, খেলেছি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন দেশে। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের ছিল। আমি চেষ্টা করেছি ব্যাটিং করে হোক বা কিপিং করে, দলের প্রয়োজনে অবদান রাখতে। আমার হয়তো আরও ভালো টেস্ট ক্যারিয়ার হতে পারতো। তবে যেটা হয়নি, সেটা নিয়ে এখন আর আফসোস মনে করি না। যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে কোন স্মৃতি বেশি মনে পড়ছে। কোন মুহূর্তের অংশ হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন?
ইমরুল: ২০১১ বিশ্বকাপের কথা আমার মনে আছে, আমরা যখন ইংল্যান্ডকে হারালাম। ম্যাচ শেষে আমরা যখন হোটেলে ফিরছিলাম, ওই রাতটার কথা আমার এখনও মনে পড়ে। আমাদের খেলা শেষ হয়েছিল রাত ১০টায়, হোটেলে ফিরতে আমাদের বেজেছিল রাত ১টা। মানুষজন যেভাবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, আমাদের তারা যেতে দেবে না, আমাদের সঙ্গে তারা আনন্দ করবে। আপনারা জানেন, আর্মি এসে মানুষগুলোকে সরিয়ে আমাদের যেতে দিয়েছিল। হোটেলের সামনেও অনেক মানুষ ছিল। ওই রাতটা মাঝেমাঝে আমাকে নাড়া দেয়। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট ও আমাদেরকে কতটা ভালোবাসে।
লংগার ভার্সন ক্রিকেটকে না বলে দিয়েছেন, সীমিত ওভারের ক্রিকেট নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
ইমরুল: আমি আগেও বলেছি বিপিএল ও ডিপিএল (ঢাকা লিগ) খেলব। এনসিএলেও টি-টোয়েন্টি খেলবো। অবশ্যই আমি চেষ্টা করবো... ওয়ানডে যেহেতু এখনও আছে, আমি অবসর নেইনি। সামনে প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলা আছে। আমি চেষ্টা করবো ক্রিকেট উপভোগ করতে। বিপিএলেও চেষ্টা করবো ভালো পারফর্ম করতে। যেখানেই খেলি না কেন, একজন ব্যাটার হিসেবে যদি রান না করেন, তাহলে আত্মতৃপ্তিটা আসে না। চেষ্টা করবো ওই তৃপ্তিটা নিয়ে ভালো ক্রিকেট খেলতে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থায় কি মনে হয় ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন?
ইমরুল: টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে খেলার মতো যে ফিটনেস লাগে, আমি যদি কাজ করতে থাকি, তাহলে হয়তো খেলতে পারবো কয়েকটা বছর। কিন্তু চার দিনের ম্যাচ খেলতে যে স্ট্রেংথ, যে মানসিকতা লাগে... আমার মনে হয়েছে, এখন তরুণদের সঙ্গে না পারি, তাহলে নিজের কাছেই খারাপ লাগে। একটা ছেলে যেভাবে বলের পেছনে দৌড়ায়, আমি তো তার সঙ্গে পারছি না। তাই মনে হয়েছে, আমি সঠিক পথে নাই। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে এক দিনে শেষ হয়ে যাবে। আপনি পুরো শক্তি দিতে পারবেন। যেটা চার দিনের ম্যাচে কঠিন। ওদিক থেকে চিন্তা করেই লংগার ভার্সনকে না বলে দেওয়া।
জাতীয় দলে থিতু হতে না পারায় নির্বাচকদের দায় কতটা দেখেন?
ইমরুল: এই মুহূর্তে এসে এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। যেটা হয়েছে, আমি মনে করি সেটা আমার কপালে ছিল। আমি বলবো না, আমি শতভাগ ঠিক ছিলাম। আমি হয়তো আরও ভালো খেলতে পারতাম। ভালো খেললে হয়তো ধারাবাহিক সুযোগ পেতাম। তবে হ্যাঁ সুযোগগুলো যদি আরেকটু শিথিল থাকতো, তাহলে হয়তো আমার ক্যারিয়ারটা ভিন্ন হতো। আমিও জানতাম না, খেলার পর আমি পরের ম্যাচে বা পরের সিরিজে থাকবো কিনা। এজন্য একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আর হতাশা নেই। আমি চেয়েছিলাম বাংলাদেশ দলকে আরও সার্ভিস দিতে। আমার পিক টাইমে আমি ভালো খেলছিলাম, চেয়েছিলাম দেশকে আরও কিছু দিতে। যেটা বললাম, হয়তো কপালে ছিল না। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি।
ক্যারিয়ারের এই লগ্নে এসে কোথাও আক্ষেপ আছে?
ইমরুল: আক্ষেপ একটা আছে... বাংলাদেশের হয়ে আমি, সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, রিয়াদ ভাই অনেক দিন একসঙ্গে খেলেছি। যদি বড় আসর থেকে একটা ট্রফি নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে ভালো লাগতো। বাংলাদেশের হয়ে দ্বিপাক্ষিক ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনও ট্রফি আনতে পারিনি। আয়ারল্যান্ডে একটা পেয়েছি। তবে এশিয়া কাপ বা নিদাহাস ট্রফির মতো বড় কিছু যদি আনতে পারতাম, তাহলে ক্যারিয়ার শেষে ভালো লাগতো।
এখন পর্যন্ত ওপেনিংয়ে সেরা সঙ্গী কে?
ইমরুল: তামিম ইকবাল অবশ্যই। আমি আর তামিম সবচেয়ে সফল ছিলাম। আমি ওর সঙ্গে ব্যাটিং উপভোগ করতাম। আমার শক্তি-দুর্বলতা ওকে জানাতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করিনি। যখন ব্যাটিং করেছি, আমি ওকে বলেছি যে এই সময়টা আমি এখন ভুগছি, এই সময়টা কঠিন মনে হচ্ছে। তামিমও এই জিনিসটা বুঝেছে। এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন সঙ্গীর সঙ্গে যদি বোঝাপড়া ভালো না থাকে তাহলে কঠিন হয়। সবাই নিজের মতো খেলতে থাকলে সম্ভব না। বোঝাপড়া থাকলে জুটিটা ভালো হয়।
পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে তামিমের সঙ্গে ৩১২ রানের জুটির স্মৃতি কতটা নাড়া দেয়?
ইমরুল: আমার মনে আছে, ২০১৫ বিশ্বকাপ যখন খেলে আসি, আমি ভালো খেলিনি। আসার পর আমাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল যে আমি কেন দলে থাকবো। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে খেলার দিন আমাকে কিছু কথা বলেছিল। যেটা আমি কিছুটা চাপে ছিলাম খেলাটা নিয়ে। আমি প্রথম ইনিংসে ফিফটি করেছিলাম। এরপর প্রায় দেড়শ ওভার কিপিংও করেছিলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম ওই গরমের ভেতরে। এরপর আমি আর তামিম যখন শুরু করি, আমরা প্রায় হারের কাছে ছিলাম। আমাদের যখন শতরানের জুটি হয়ে যায়, তামিম আমাকে বলছিল, ‘দোস্ত আমি আর তুই পারি টেস্ট ম্যাচটা ড্র করতে। জানি কষ্ট হবে। আরেকটু কষ্ট করলে হয়তো ম্যাচটা ড্রয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারবো।’ এভাবে খেলতে খেলতে যখন দুইশ হয়ে গেলো, আড়াইশ হয়ে গেলো, তখন বিশ্বাস চলে আসে যে এই ম্যাচটা আমরা ড্র করবো। এভাবে আসলে জুটিটা গড়ে উঠেছিল।
ক্রিকেট ছাড়ার পর নিশ্চয়ই বিশেষ কোনও পরিকল্পনা আছে?
ইমরুল: ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর আসলে... এখন তো সবকিছু উন্মুক্ত। আমি বেশিরভাগ সময়ই অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। সেখানেই আমার থাকতে হবে। কারণ আমার পরিবার সেখানে থাকে। ওখানেও অস্ট্রেলিয়ার একটা দলের হয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলছি আমি। ওখানে একটা কোচিং একাডেমি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে কথাবার্তা চলছে, কাজ করছি। আশা করছি, আগামী বছরের দিকে এটা আমরা শুরু করবো। আমি চাই ক্রিকেট ছাড়ার পর ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকতে এবং ক্রিকেটের আরও উন্নত জ্ঞান পেতে। সবাই জানেন, অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেটের সবকিছু আধুনিক। সেখান থেকেই আধুনিক সব বিশ্লেষণ হয়। আমি চেষ্টা করবো, সেখানে বড় বড় পর্যায়ে কাজ করতে। সেখানে কোচদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা নেওয়ার আছে। ভবিষ্যতে যদি কখনও বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়, আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করবো।
অবসরের ঘোষণা দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হচ্ছে, এটাকে কীভাবে দেখেন?
ইমরুল: বিসিবিকে ধন্যবাদ। আমি যখন তাদের প্রস্তাবটা দেই, তারা বিষয়টা খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। আমি হয়তো আরও দুই বছর খেলতে পারতাম। আমাকে অনেকে বলেছে, ভাই আপনি আরও দুইটা বছর খেলতে পারতেন। কিন্তু আমার কথা হলো, দুই বছরের পর সে হয়তো বলতে পারে, ভাই আপনি কখন ছাড়বেন। তাই আমার মনে হয়েছে, এই কথাগুলো শোনার চেয়ে, নিজের থেকে আমি বুঝেছি যে আমার এখন চলে যাওয়াটা ভালো। এজন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সম্মান থাকতে থাকতে নিজ বুঝটা পাওয়া ভালো।
সামনে তো অনেক ক্রিকেটার আছে, তারা খেলবে। আমাদের ক্যারিয়ার শেষ। আমাদের জায়গায় নতুন একটা ছেলে আসবে। তার জন্য লম্বা একটা সুযোগ থাকবে। অনেক কিছু চিন্তা করেই আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
অনেকের সঙ্গেই খেলেছেন, তরুণদের মধ্যে কাকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে?
ইমরুল: তরুণদের মধ্যে আমি এখন পর্যন্ত যে কয়জনের ব্যাটিং দেখলাম, আমার কাছে ভালো লেগেছে অমিত হাসানকে। সিলেটের হয়ে খেলছে। খুব ভালো ব্যাটার। টেকনিকের দিক থেকে, টেম্পারমেন্ট টেস্ট ক্রিকেটের জন্য পারফেক্ট আমি মনে করি। হয়তো নির্বাচকরা তাকে চিন্তা করবে। সে যদি পারফর্ম করতে থাকে, দলে আসবে অবশ্যই।
আপনার দৃষ্টিতে সেরা কোচ, অধিনায়ক কে?
ইমরুল: এটা তো কঠিন প্রশ্ন... সেরা কোচ, সেরা ক্যাপ্টেন। সেরা ক্যাপ্টেন... সবার সঙ্গেই খেলেছি, মুশফিক থেকে শুরু করে আশরাফুল ভাই, লাস্ট খেললাম মাশরাফি ভাইয়ের সময় পর্যন্ত। সবমিলিয়ে আপনি যদি আমাকে বলেন ভালো অধিনায়কত্ব বাংলাদেশের হয়ে কে করেছে, আমি বলবো সাকিব আল হাসান। কারণ ওর সময়ে খেলে আমি আমার ভূমিকাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতো, কী আমার ভূমিকা, কীভাবে খেলতে হবে। হাথুরুসিংহে, আমি আবারও বলছি... অবশ্যই তিনি অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ কোচ। কিন্তু টেকিনক্যাল কোচ হিসেবে তিনি অনেক ভালো কোচ ছিলেন। হয়তো তার অ্যাটিচিউডে অনেক সমস্যা ছিল, অনেকের সঙ্গে বনিবনা হতো না। কিন্তু ব্যাটার হিসেবে আমি উনার কাছ থেকে অনেক শিখেছি। ওদিক থেকে বলবো, এ দুজনকে আমার ভালো লেগেছে।
কোন কোচ আপনাকে ঠিকভাবে বুঝতে পারেননি?
ইমরুল: বোঝে নাই এরকম না। আসলে আমি একটু কোচদের থেকে দূরে থাকতাম। এজন্য থাকতাম, হয়তো কথা বেশি বলতাম না কোচদের সঙ্গে। এত বেশি কোচ অরিয়েন্টেড হতে চাইতাম না। আমার সবসময় পরিকল্পনা ছিল, আমি ভালো খেলবো, ওর কাছ থেকে পজিটিভ কিছু নেওয়ার থাকলে নেবো। এর বাইরে কিছু চিন্তা করতাম না।