শেখ মোরসালিনের সাক্ষাৎকার

‘সারা রাত ঘুমাতে পারিনি’

হঠাৎ জাতীয় দলে ডাক পেয়ে আলোচনায় চলে এসেছেন শেখ মোরসালিন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বে মালদ্বীপ ও ভুটানের বিপক্ষে দুটি গোল করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। হাভিয়ের কাবরেরার আস্থার প্রতিদান দিতে পেরে খুশি ১৯ বছর বয়সী এই ফুটবলার। তবে সেমিফাইনালে কুয়েতের বিপক্ষে শুরুতে গোলের সুবর্ণ সুযোগটি মিস করায় তা ভীষণ পোড়াচ্ছে তাকে! আক্ষেপ হচ্ছে এমনটা না হলে হয়তো ১৮ বছর ফাইনালের স্বাদটিও বাংলাদেশ পেতে পারতো। কিন্তু কেন এমন হলো? সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের পারফরম্যান্স ও টুর্নামেন্টের বিভিন্ন আলোচিত বিষয় নিয়ে রবিবার বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থেকে উঠে আসা এই মিডফিল্ডার…

প্রশ্ন: শুরুতে আগের রাতে গোল মিসের প্রসঙ্গে চলে আসি। নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে?

মোরসালিন: খারাপ তো লাগছেই। কখনও ভাবিনি এই অবস্থায় বল পেয়েও গোল মিস হবে। কেননা, ওই পজিশনে অনুশীলনে আমি নিয়মিত গোল করে থাকি। সাধারণত এমন পজিশন থেকে গোল মিস হয় না। কেন যে এমন হলো বুঝতে পারছি না। জানেন আমি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। শুধুই আফসোস করেছি। 

প্রশ্ন: ওই গোলটা হলে তো কুয়েতের বিপক্ষে ম্যাচটা অন্যরকম হতে পারতো?

মোরসালিন: তা তো হতে পারতোই। এমনিতে আমাদের দলটি দারুণ উজ্জীবিত ছিল। আগে গোল পেলে তখন দলের চেহারা আরও বদলে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি, কী করার আছে। তবে অনেক খারাপ লাগছে। বারবারই নিজেকে প্রশ্ন করে কোনও উত্তর পাচ্ছি না।

প্রশ্ন: অন্য প্রান্তের ক্রসটি যখন আপনার পায়ে আসছিল তাৎক্ষণিক কী চিন্তা করছিলেন?

মোরসালিন: ওই পজিশনে বল পেয়ে গোলকিপারের পাশ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেলো। বল গিয়ে সোজা গোলকিপারের গায়ে লাগলো। এমনটি আমি আশাই করিনি। শুরুতে গোল পেলে দল আরও উজ্জীবিত হয়ে খেলতে পারতো। তখন ম্যাচের চিত্রটা পাল্টে যেতে পারতো।

প্রশ্ন: তাহলে আফসোস নিয়েই দেশে ফিরতে হচ্ছে...

মোরসালিন: তাই তো। এছাড়া কি করার আছে। আমরা সবাই মিলে কম চেষ্টা করিনি। পুরো দল এক হয়ে খেলার চেষ্টা করেছে। সেটা শুরু থেকে। দলের পারফরম্যান্স দেখলে তা পরিষ্কার হবে। সেমিফাইনালে এসে জয়রথ থেমে গেলো।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ দল শুরু থেকে একই তাল-লয়ে খেলেছে। আপনি তো প্রথমবার দলে খেললেন, এর রহস্য কী মনে হচ্ছে?

মোরসালিন: আসলে আগে কী হয়েছে সেটা তো আমি বলতে পারবো না। তবে এবার দলে ঢুকেই দেখেছি সবাই দারুণ উদ্দীপ্ত ছিল। কিছু একটা করার তাড়না সবার মাঝে ছিল। অনুশীলন কিংবা টিম মিটিং বলুন না কেন, সব জায়গায় নৈপুণ্য দেখিয়ে খেলার চেষ্টা করার পণ ছিল সবার মাঝে। সেটা মাঠে কতটুকু দেখানো হয়েছে তা দর্শকরা ভালো বলতে পারবেন। আমার দৃষ্টিতে বলবো কেউ কোনও কমতি রাখেনি। শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

দুই গোলদাতা শেখ মোরসালিন ও রাকিব হোসেন।প্রশ্ন: প্রথমবার জাতীয় দলে এসে চমক দেখিয়েছেন। দুটো গোল ছাড়া অন্য পারফরম্যান্সও ভালো ছিল। তাছাড়া এই দলে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড়ও আপনি। সবার সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন?

মোরসালিন: আসলে আমি আমার নিজের পারফরম্যান্সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। যদি কুয়েতের বিপক্ষে গোলটা পেতাম তাহলে আজ হয়তো ফাইনালে খেলার সুযোগ হতে পারতো। না হওয়ায় মনটা খারাপ। দলও হেরেছে। তবে নিজেকে সামনের দিকে আরও শানিত করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে আরও ধারালো করে উপস্থাপনা করা ছাড়া বিকল্প দেখছি না। এছাড়া দলে নতুন হিসেবে কোচ ও অন্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি। সবাই সাধ্যমতো সঙ্গ দিয়ে গেছে। নতুন হিসেবে কেউ আমাকে অন্য চোখে দেখেনি।

প্রশ্ন: বাবা-মা তো নিশ্চয়ই খুশি? তাদের ছেলে জাতীয় দলে খেলছে, দুটি গোলও পেয়েছে।

মোরসালিন: বাবা-মা তো অনেক খুশি। তাদের ছেলে জাতীয় দলে খেলেছে, গোল পেয়েছে। ফোনে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কখন বাড়ি আসবো জানতে চেয়েছে। আসলে সবই ঠিক আছে, ওই গোল মিসের জন্য আফসোস হচ্ছে। বড় দলের বিপক্ষে এমন সুযোগ সবসময় আসে না। পুরো ম্যাচ ভালো খেলে আমার গোল মিস আর শেষ দিকে এসে কুয়েত গোল পাওয়ায় আমরা ছিটকে যাই। এই আফসোস আমার অনেক দিন থাকবে।

প্রশ্ন: আপনি তো মিডফিল্ডার। কিন্তু ওপরের দিকেও সব পজিশনে খেলতে দেখা গেছে।

মোরসালিন: আমি সব পজিশনে খেলতে পারি। এটা আমার গুণ বলতে পারেন। কোচ যেভাবে খেলতে বলে সেভাবে খেলে থাকি। এই যেমন বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শটে গোল করাটা আমার অনুশীলনের ফসল বলতে পারেন। তাই কোনও পজিশনে খেলতে ভয় করি না। নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। আস্থার প্রতিদান দিতে পারলে নিজের কাছেই ভালো লাগে।

প্রশ্ন: ২০০৯ সালের পর দল সেমিফাইনালে খেলেছে। কুয়েতের বিপক্ষে লড়াই করে হেরেছে। তারপরও কিছু ভালোলাগা...

মোরসালিন: তা তো আছেই। আফসোসের পাশাপাশি ভালোলাগা কাজ করছে। অনেকটা সুখস্মৃতি নিয়েই কাল দেশ ফিরতে পারি। দেশে এসে নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে হবে। বেশি বেশি অনুশীলন। এরপর মাঠের খেলাতে একের পর এক লক্ষ্যভেদ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যাতে সামনের দিকে কোনও খেলাতে কুয়েতের বিপক্ষে যেমন মিস হয়েছে তা যেন না হয়।

প্রশ্ন: আমরা শেষের দিকে চলে এসেছি। আপনি আগে বলেছিলেন, ফুটবলের জন্য বাবা-মার আদর ঠিকমতো পাননি। বুটও কিনতে হয়েছে বৃত্তির টাকা দিয়ে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল করেও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। এখন কী মনে হচ্ছে?

মোরসালিন: ফুটবলের জন্য অনেক কিছু আমাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। এ নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। এত দ্রুত জাতীয় দলে জায়গা পাবো কল্পনা করিনি। জায়গা পেয়ে একাদশে খেলেছি, দুটি গোল করেছি। দেশবাসীকে চেষ্টা করেছি আনন্দ দিতে। কতটুকু পেরেছি সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। এছাড়া দেশের জন্য খেলতে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। এখন কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। আসলে বাবা-মার আদর কিংবা পড়াশোনা যাই বলুন না কেন, সবকিছুই ফুটবলের জন্য। মাত্র তো ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে। আমাকে এখন অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।