‘ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছা থেকেও উদ্যোক্তা হওয়া যায়’

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটা মাথার ভেতর পোক্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সেটাকে আলোর মুখে আনা এনায়েত রশিদের জন্য সহজ হয়ে যায়। এছাড়া পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল ব্যবসা। ফলে আর কী লাগে। বাস্তবের এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এনায়েত রশিদ হয়ে গেলেন উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ট্রাক লাগবে’র মতো স্টার্টআপ। বর্তমানে তিনি ‘ট্রাক লাগবে’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী।

দেশের ৫০ হাজারের বেশি ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান ‘ট্রাক লাগবে’র নেটওয়ার্কে। এই নেটওয়ার্ক আরও বড় করতে চান এনায়েত রশিদ। এর পাশাপাশি তিনি ট্রাক লাগবে’কে নিয়ে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চান, যেখানে চালকরা ট্রাকের চাকা, ইঞ্জিন অয়েল, গিয়ার অয়েল, ট্রাক কেনার জন্য ঋণ পাবেন। কারও ট্রাক, পিকআপ বা কাভার্ড ভ্যান প্রয়োজন? ট্রাক লাগবের অ্যাপে যান। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান মিলে যাবে।  

বাংলা ট্রিবিউন: উদ্যোক্তা হলেন কীভাবে?

এনায়েত রশিদ: নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি বিভিন্ন ক্লাবে যুক্ত ছিলাম। এর মধ্যে ‘আইজেক’ নামে একটি বিদেশি ক্লাব ছিল। তারা এমনভাবে সবার মানসিকতা গড়ে তুলতো— যেন প্রত্যেকেই জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করতে পারে। আমিও তখন থেকেই ভাবতে থাকি, জীবনে কী করতে চাই। সবসময় ভাবতাম, জীবনটা সার্থক হতে হবে। আমার মাধ্যমে যেন অনেকের কর্মসংস্থান হয়— সেরকম কিছু করতে হবে। মূলত এসব ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হয়েছি।

বাংলা ট্রিবিউন: উদ্যোক্তা হতে কী প্রয়োজন?

এনায়েত রশিদ: উদ্যোক্তা হতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজের মনকে ঠিক করা। কী করতে চাই সেটা বুঝতে পারা। অনেকে শুধু অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করেন। আবার কেউ কেউ খোঁজেন তৃপ্তি— যারা এই দুটো বিষয়কে একত্রে চান, তারা উদ্যোক্তা হতে পারেন। তাছাড়া ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছা থেকেও উদ্যোক্তা হওয়া যায়। অনেকে যেটা গতানুগতিক উপায়ে করছে, সেটা ইনোভেটিভ উপায়ে করা অনেক বেশি আনন্দের।

বাংলা ট্রিবিউন:  ‘ট্রাক লাগবে’ এই নামটার জন্ম কীভাবে?

এনায়েত রশিদ: আমাদের লক্ষ্য ছিল— ট্রাক বিষয়ক সমস্যার সমাধান করা। এজন্য নাম ঠিক করতে একসপ্তাহ মিটিং করতে হয়েছে। তবে আমাদের কোনও নামই পছন্দ হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে আমাদের এক সহ-প্রতিষ্ঠাতা বললেন, ‘অনেক নামই তো এলো। কোনোটাই পছন্দ হয়নি। নাম দিয়ে দিই- ট্রাক লাগবে।’ তার এই প্রস্তাব আমাদের খুব পছন্দ হলো। নাম ছোট, সহজ বাংলা নাম। সবচেয়ে বড় কথা হলো— আমরা কী নিয়ে কাজ করি, তা নাম দিয়েই যেন বোঝা যায়। ফলে এটিই সিলেক্ট করা হলো।

 

বাংলা ট্রিবিউন: এতকিছু থাকতে ট্রাক কেন?

এনায়েত রশিদ: আমি ব্যবসায়িক পরিবারের ছেলে। আমাদের ব্যবসায় ট্রাক লাগতো। এ কারণে দেখতাম— একেক সময় একেক রেটে ট্রাক ভাড়া করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ট্রাক পাওয়া একটা বড় সমস্যার নাম ছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম— শুধু আমার নয়, আমার বন্ধুও একই সমস্যা মোকাবিলা করছে। বুঝতে পারলাম, এটা অনেকেরই সমস্যা এবং বড় একটি সমস্যা। ২০১০ সালে এটি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের প্রবলেম। রিসার্চ করে বুঝলাম, এই সমস্যার সমাধান একসঙ্গে পাওয়া যাবে না। ধাপে ধাপে সমাধান করতে হবে। এসব কারণেই ট্রাক নিয়ে কাজ শুরু।

বাংলা ট্রিবিউন: কেন ট্রাক লাগবে?

এনায়েত রশিদ: মানুষ যেসব জামা-কাপড় ব্যবহার করছে, সেগুলো কয়েকবার ট্রাকে উঠেছে। আমাদের খাবারও একের অধিকবার ট্রাকে উঠে থাকে। চারপাশে যা আছে, তা একবার হলেও ট্রাকে উঠেছে। যেখানে রাস্তা আছে সেখানে ট্রাক যায়। শুধু তাই নয়, যেখানে রাস্তা নেই, সেখানেও ট্রাক যায়। কারণ, রাস্তা তৈরির উপকরণ এই ট্রাকের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছায়। একটি জায়গায় ট্রাক যায় মানে শুধু ট্রাকটি যাচ্ছে না। সেই ট্রাকে করে যদি বই যায়, তার মানে ট্রাকের মাধ্যমে শিক্ষা গেলো। ট্রাকে করে যদি জেনারেটর যায়, তার মানে পাওয়ার গেলো। এভাবে ভাবলে বোঝা যায়, ট্রাক আমাদের জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ। আর সবক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বাহনটি সহজলভ্য করতেই ট্রাক লাগবে।

বাংলা ট্রিবিউন:  ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যানকে কীভাবে একটা নেটওয়ার্কে নিয়ে এলেন?

এনায়েত রশিদ: বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। অল্প জায়গা হওয়ায় এখানকার মোটামুটি সব যানবাহন একজেলা থেকে অন্য জেলা বা বিভাগে সহজে চলে যায়, যেটা বড় কোনও দেশে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে জেলা থেকে জেলায় ছোট গাড়িও যায়, আবার বড় গাড়িও যায়। এ কারণে সব ধরনের গাড়িই প্রয়োজন হয়। ফলে আমরা সবগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করি। প্রথমে আমরা ছোট গাড়িগুলো নিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর পর্যায়ক্রমে মাঝারি এবং বড় গাড়িগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসি।

বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাকচালকদের ভাষা বা যোগাযোগের ধরন আলাদা। তাদের ভাষা বোঝেন কীভাবে?

এনায়েত রশিদ: আমরা আসলে কাজ করতে করতে তাদের ভাষা বুঝেছি। তাদের আচরণে একটু রুক্ষতা আছে। সারাদিন বাইরে থাকতে হয়, বাইরে খাওয়া-দাওয়া, বাইরে ঘুম, সারা দিন ড্রাইভিং। সব মিলিয়ে তাদের জীবনটা কষ্টকর, ফলে ভাষাও একটু কর্কশ। তবে আমরা সবসময় তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলেছি। কাউকে অবমূল্যায়ন করিনি। আমাদের এই নীতি অনেক বড় মাইলেজ এনে দিয়েছে। শুরুতে তারা আমাদের সঙ্গে একটু শক্তভাবে কথা বললেও পরে নরম হয়ে যায়। তারা আমাদের থেকে সম্মান পেয়ে অনেক সহজ হয়ে যায়, আমাদের খুব পছন্দ করে। ট্রাকগুলোকেও একেক এলাকায় এবং একেক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। আমরা কাজ করতে করতে সেগুলো বুঝে গেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাক ড্রাইভারদের বেশিরভাগেরই ‘ডিজিটাল লিটারেসি’ নেই। ফিচার ফোন ব্যবহার করে। তাদেরকে কীভাবে স্মার্টফোনে উদ্বুদ্ধ করলেন?

এনায়েত রশিদ: আমরা কাজ শুরু করেছি ছোট গাড়ি দিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের ছোট গাড়ির মালিক এবং ড্রাইভার উভয়েরই বয়স সাধারণত কম হয়ে থাকে। তারা অলরেডি স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। আমরা শুধু তাদের শিখিয়েছি যে, এই স্মার্টফোন ব্যবসায়িক কাজে লাগানো যেতে পারে। অনলাইনে ট্রিপ ধরা, ট্রিপ নিয়ে দরাদরি করা, এসব বিষয়ে তারাও মজা পায়। অপরদিকে বড় গাড়িতে এটা করতে গিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। কারণ, বড় গাড়ির বেশিরভাগ ড্রাইভারের বয়স বেশি। দামি ফোন নিয়ে তারা ঘুরতে চান না। তারপরও যারা আছেন, তাদের আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি, শিখিয়েছি। ইন্টারনেট থেকে ট্রিপ নিয়ে তারা আবার অন্যদের সঙ্গে সেটা শেয়ার করেছেন। এভাবে আমাদের অ্যাপের তথ্য একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: সব ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান— আপনাদের নেটওয়ার্কে এসেছে?

এনায়েত রশিদ: সব আসেনি। তবে অনেক ট্রাক এখন আমাদের নেটওয়ার্কে আছে। এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হবে। ধীরে ধীরে আরও যুক্ত হচ্ছে। একসময় হয়তো দেশের বেশিরভাগ ট্রাকই আমাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে।

বাংলা ট্রিবিউন: তাদের ট্র্যাক করেন কীভাবে?

এনায়েত রশিদ: আমাদের জিপিএস সার্ভিস আছে। আমাদের নেটওয়ার্কে যারা যুক্ত তারা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে— তার সবকিছুই আমরা ট্র্যাক করি। তবে নেটওয়ার্কের বাইরের কোনও ট্রাকের ক্ষেত্রে ট্র্যাক করা হয় না।

বাংলা ট্রিবিউন: দুর্ঘটনা ঘটলে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন?

এনায়েত রশিদ: ড্রাইভারদের বলা আছে, দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথমেই পুলিশকে জানাতে হবে। এরপর আমাদের। দুর্ঘটনাভেদে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব নীতিমালা আছে। কোনও দুর্ঘটনায় মালামালের ক্ষতি হয়, কোনোটিতে গাড়ির ক্ষতি হয়, আবার কখনও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। এসব প্রত্যেকটি বিষয়ে আমরা আলাদা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাক লাগবে ভবিষ্যতে কী আনছে?

এনায়েত রশিদ: ট্রাকে বা ট্রাক ব্যবসায় যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই আমরা দেবো। ট্রাক সম্পর্কিত যাবতীয় সবকিছু আমাদের প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে। যেমন- কারও ট্রাকের চাকা দরকার, আমাদের এখানে পাবে। আবার ট্রাক কিনতে কারও ঋণ দরকার, আমাদের এখানে এলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ট্রাক সম্পর্কিত সবকিছুই এক প্ল্যাটফর্মে থাকবে।

বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এনায়েত রশিদ: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।