বাংলা ট্রিবিউনকে তারানা হালিম

‘হুমকি-ধমকি হলো ভালো কাজের স্বীকৃতি’


ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন,‘বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে (আঙুলের ছাপ) সিম নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি পাচ্ছি। কিন্তু আমি থামব না। এর শেষ না দেখে যাবও না। হুমকি-ধমকি পাওয়া হলো ভালো কাজের স্বীকৃতি। বরং হুমকি-ধমকি না পেলে  মনে হয়, কাজের গতি বুঝি কমে গেলো।’

সিম নিবন্ধনের কাজটিকে তিনি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এই যুদ্ধ থেকে ফেরার কোনও সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, পদটা অস্থায়ী, কীর্তিটা স্থায়ী। যতদিন দায়িত্বে আছেন ততদিন যত হুমকিই আসুক না কেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কাজ শেষ করে মোবাইলফোন ব্যবহারকারীদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান তিনি।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব ছাড়াও তার ৯০ দিনের পরিকল্পনা, টেলিটকের রি-ব্র্যান্ডিং, ইন্টারনেটের দাম কমানোসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেন।   

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ৯০ দিনের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে জানতে চাই। 

তারানা হালিম: ৯০ দিনের কর্মসূচিটির বাস্তবায়নের একটি হার তৈরি করেছিলাম। সেখানে সব মিলিয়ে সাফল্যের গড় হার ছিল ৮০-৮৫ শতাংশ।

আমি মনে করি,প্রতিটি কাজের জন্য একটা টার্গেট এবং টার্গেটের জন্য সময় থাকতে হবে।সবসময়ই আমি টাইম বাউন্ড টার্গেটের কথা বলি।এতোদিনের মধ্যে এটা করব,এতোদিনের মধ্যে ওটা করব। তাহলে আমার নিজের মধ্যেই কাজটি করার তাড়া থাকে।একইসঙ্গে আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, মন্ত্রণালয়ে যারা থাকেন তাদের মধ্যেও একটা ‘অ্যাকাউন্টিবিলিটি’ তৈরি হয়-আমাকে এতোদিন পরে জানাতে হবে; আমি পারলাম,কি পারলাম না।দায়িত্ব নেওয়ার পরে দেখলাম মন্ত্রণালয়ে সবকিছু ঝিমিয়ে পড়েছে।

আমি আগে জানতাম না এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবো। তাই দায়িত্বে এসেই ৯০ দিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করি। দায়িত্ব নেওয়ার সময় মন্ত্রণালয়ের সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলাম, এটা আপনার সংস্থার সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রথম মাপকাঠি হবে। তাই প্রত্যেকে পরস্পরের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ুন লক্ষ্য অর্জন করতে। তবে খুব উচ্চাভিলাষী কোনও টার্গেট আমার ছিল না।

ধরুন, সিম নিবন্ধনের বিষয়টি। নভেম্বরে প্রজেক্ট হবে, ডিসেম্বরে শুরু হবে, এপ্রিলের মধ্যে আমার শেষ করার ইচ্ছা।এটাতেই লক্ষ্য ঠিক রেখেছি। বলেছি, এমএনপিও (মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি) এপ্রিলে শুরু করতে পারব।

বাংলা ট্রিবিউন: বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের আইডিয়াটা কীভাবে পেলেন?

তারানা হালিম: আমি শুনেছিলাম প্রি-অ্যাকটিভেটেড (আগে থেকে চালু) সিম বাজারে পাওয়া যায়। আমি তিন চারটা জায়গায় গিয়ে দেখলাম কীভাবে কাজটি হচ্ছে। এটা দেখার পরে মোবাইলফোন অপারেটরদের ডাকলাম। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমরা আমার দেশে ব্যবসা করো, লাভ করো, আমরাও রাজস্ব পাই। কিন্তু এইভাবে কাজটি কি তোমরা তোমাদের দেশে করতে পারতে? তখন সবাই বলে, ‘না’। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে আমাদের দেশে তোমরা এটা কেন করছ? কেন কোনও নিয়ম নেই।সবাইকে বললাম,তোমরা তোমাদের সিমের ডাটাবেজটা বাল্ক ভেরিফিকেশনের জন্য এনআইডি  কর্তৃপক্ষকে পাঠাও। দু’দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এনআইডি থেকে যখন খবর পাবো বাল্ক ভেরিফিকেশনের জন্য সিমের ডাটাবেজ সেখানে পৌঁছেছে, তখনই আমি অফিস থেকে বের হব। সব মোবাইলফোন অপারেটরকে ফোন করে এই কথাটি বলি। সেদিন রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত অফিসে ছিলাম। এনআইডি  কর্তৃপক্ষের কাছে ডাটাবেজ পৌঁছার ফোন এলে আমি অফিস থেকে বের হই।

বাল্ক ভেরিফিকেশনের জন্য সবগুলো অপারেটর মাত্র ২২.০৮ শতাংশ ডাটা সরবরাহ করে। কিন্তু সরবরাহকৃত ডাটার ভিত্তিতেই যে চিত্র দেখলাম সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র ছিল।দেখলাম,একটা এনআইডির (জাতীয় পরিচয়পত্র) বিপরীতে ২১ হাজার, আরেকটির বিপরীতে ৬ হাজার ৭০০, ৬ হাজার ৫০০ এমন সংখ্যক সিমের নিবন্ধন রয়েছে।এমনকি একটি ভুয়া এনআইডির বিপরীতে সিমের নিবন্ধন ৬ হাজার ২৭৫টি।তার মানে এই সিমগুলো কোথায় আছে আপনি জানেন না, কে ব্যবহার করছে আপনি জানেন না, কোন কাজে ব্যবহার হচ্ছে তাও আপনি জানেন না।অথচ নাম রয়েছে আপনার।

আমি তখন বিটিআরসি ও এনআইডি কর্তৃপক্ষকে বললাম,বিষয়টি সমাধানের জন্য আমাকে প্রেজেন্টেশন দেন।আমরা তো সব সময় সমস্যার কথা বলি। এবার সমাধানের পথ খুঁজতে শুরু করলাম। তখন জানতে পারলাম, এনআইডিতে টেমপ্লেট আকারে ৪টা আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। জানতে চাইলাম, আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ না করে এটা কী করে সমাধান করা সম্ভব। তখন আমরা অলোচনা করলাম আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ না করে কিভাবে এটা করা যায়। তখন আইডিয়া এলো, আঙুলের ছাপের মাধ্যমে নিবন্ধন। এই বায়োমেট্রিক মেশিনে আঙুলটা রাখার পর সেটা আর আঙুলের ছাপ থাকছে না। সেটি টেমপ্লেট হচ্ছে এবং টেমপ্লেটটি কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে একটি বায়োমেট্রিক কোডে। এভাবে কাজটা শুরু হয়ে গেল।

গ্রাহকের আঙুলের ছাপ ছাড়া আর কিছুই রাখা হচ্ছে না। অর্থাৎ এনআইডিতে যা আছে, তার অতিরিক্ত আমরা কিছুই করছি না।

বাংলা ট্রিবিউন: কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, কথা হচ্ছে, আঙুলের ছাপ কপি হয়ে যেতে পারে। বিদেশি বেনিয়াদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে?

তারানা হালিম:প্রোপাগান্ডা চলছে যা খুবই দুঃখজনক। আমরা ভিসার জন্য বিদেশি অ্যাম্বাসিতে গিয়ে আমাদের সবগুলো আঙুলের ছাপ দিয়ে আসি। আইরিশও (চোখের স্ক্যান) দিয়ে আসি। ভেন্ডরের কাছে গিয়েও এসব দিচ্ছি। অথচ ওই ভেন্ডরের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। বিভিন্ন অফিসে ঢোকার মুখে দিচ্ছি। কোনওটাতেই প্রশ্ন উঠছে না। মোবাইলফোন অপারেটরকে দেওয়ার বেলায় উঠছে। এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় যে মহলটির স্বার্থে আঘাত লেগেছে তারাই বিরোধিতা করছে।

বাংলা ট্রিবিউন:আপনি বলছেন যে,যুদ্ধে নেমেছেন। এই যুদ্ধটা কাদের বিরুদ্ধে?

তারানা হালিম:এই যুদ্ধটা যারা জঙ্গিদের অর্থায়ন করে, জঙ্গিবাদকে মদদ দেয়, যারা সন্ত্রাস করে, মাদক ব্যবসা করে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করে, অর্থাৎ একটি বিশাল অপশক্তির বিরুদ্ধে।

আমি অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ করতে চাই। এই অবৈধ ভিওআইপির কারণে আমাদের কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এর আগে অবৈধ ভিওআইপির কারণে সিম আটক করা গেলেও এর পেছনে কে আছে তাকে আটক করা যাচ্ছিল না। কারণ সিমটি সঠিকভাবে নিবন্ধিত ছিল না।  

আমি বিশ্বাস করি, এই কাজটি যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারি তাহলে মোবাইলফোন বিষয়ক অপরাধগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।

বাংলা ট্রিবিউন: হুমকি-ধমকি ও চাপের কথা বলছিলেন।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তারানা হালিম: এই কাজ শুরু পর থেকে প্রতিদিনই আসছে। প্রতিদিন নিয়ম করেই হুমকি ধমকি পাচ্ছি। যখন দুই একদিন হুমকি পাই না তখনই মনে হয় আমার কাজের গতিটা কিছুটা কমে গেলো কি না। আমি মনে করি, খারাপ শক্তি যখন হুমকি দেয় তখন সেটা আপনার ভালো কাজের স্বীকৃতি।  মানুষ এই কাজটির গুরুত্ব বুঝতে পারবে।

টাকা-পয়সা দিয়ে অনেকে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। ভুয়া অনলাইনে ভুয়া নামে অনেক প্রোপাগান্ডা চলছে। আমি  জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এতো বেশি হুমকি পেয়েছি যে, এখন আর আমি ভয়ই পাই না।

বাংলা ট্রিবিউন:এই কাজটি সম্পন্ন হলে মোট মোবাইল গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর সংখ্যায় একটা পরিবর্তন আসবে।

তারানা হালিম: হ্যাঁ, সিম নিবন্ধন সম্পন্ন হলে দেশে সিমের সংখ্যা, এমনকি মোবাইলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা  কমে যাবে। কিন্তু যেনতেনভাবে সংখ্যা বৃদ্ধি এটা তো কোনও লজিক হতে পারে না। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সিমগুলো বাজারে আছে- এটাই হলো লক্ষ্য। এটা শুধু সংখ্যার বিষয় নয়। এটা বৈধতারও বিষয়। আমরা বৈধতার ক্রেডিট নিতে চাই।   যদি সিম সংখ্যা কমেও যায় তা আবার বাড়বে। রাজস্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে, তবে সিম কিন্তু আবার কিনবে মানুষ। সেখান থেকে আমরা আশাবাদী।

বাংলা ট্রিবিউন:ইন্টারনেটের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তারানা হালিম:ইন্টারনেটের দাম গ্রাহক পর্যায়ে কমাতে চাই। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমাতে গেলে আমাদের রেভিনিউতে একটু ইফেক্ট পড়ে। তবুও আমাদের গ্রাহকদের একটু রিলিফ দেওয়ার ইচ্ছা আছে। এই দামের মধ্যেই আমরা গ্রাহক পর্যায়ে দাম আরও কমাতে পারতাম যদি মধ্যস্বত্বভোগী না থাকত। তবুও আমরা চেষ্টা করব গ্রাহক পর্যায়ে দাম আরও কমাতে।  

ইন্টারনেট দুনিয়া নিরাপদ রাখতে ‘ইন্টারনেট সেফটি সলিউশন’ আমাদের আনার ইচ্ছা আছে। কিন্তু দামের বিষয়টা আমরা আরও যাচাই বাছাই করছি। এর মধ্যে  আইআইজিগুলোর পর্যাপ্ত ক্যাপাসিটি আছে কি না এগুলো বিটিআরসি যাচাই করছে। আইএসপিগুলো তাদের হালনাগাদ তথ্য আমাদের দিচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংজ্ঞা বদলেছে। গতি বাড়বে কবে?

তারানা হালিম: ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারিত হয়েছে। ন্যূনতম গতি ৫ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) কার্যকরও হয়ে গেছে। আগে যেমন ১ এমবিপিএস পাওয়া যেত সেটা এখন ২ এমবিপিএস হয়ে গেছে। আমাদের লক্ষ্য ৫ এমবিপিএস। কিছু জায়গায় হয়নি কারিগরি সমস্যার কারণে। আমরা খবর নিয়েছি সেসব জায়গায় ৩ বা ৪ এমবিপিএস হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: টেলিটকের লোগো বদলেছে। সেবার মান বদলাবে তো?

তারানা হালিম: দুটি প্রতিষ্ঠানকে টেনে তোলার চেষ্টা করছি। একটা হচ্ছে টেলিটক আরেকটি হচ্ছে ডাক বিভাগ। টেলিটককে বাড়তি কোনও সুবিধা দেব না।  তাদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলে এই মার্কেটে আমি ছেড়ে দিতে চাই। টেলিটককে বলেছি, আপনাদের বিনিয়োগ কম। আপনারা থ্রিজির সময়ে অনেক বড় সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। যে আর্থিক সক্ষমতা আছে সেটার মধ্যেই আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করতে পারি। কাস্টমার কেয়ারের সংখ্যা ও খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি, বাজারে সিম প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং বাজারে রিচার্জ করার সুযোগ বাড়াতে বলি। তাদের সময় বেঁধে দিয়েছিলাম ৬ মাস। ৬ মাস পরে টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা ১০ লাখের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। সিম আগে ছিলো ৩২, এখন হয়েছে ৪২ লাখ। টেলি রিচার্জ স্টেশনের সংখ্যাও বেড়েছে। রি-ব্র্যান্ডিং করেছি, কারণ পরিবর্তন আনার দরকার। মানুষ একই জিনিস দেখছে, একটু পরিবর্তন চায়।

টেলিটকের উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে বিটিএস আনছি। এখন আমাদের লক্ষ্য টেলিটকের নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ।  টেলিটকের নেটওয়ার্ক নিরবচ্ছিন্ন হবে। ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা বিকাশের সঙ্গে চুক্তি করেছি মোবাইল ব্যংকিং নিয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছি তাদের ফলগুলো আমাদের টেলিটকের মাধ্যমে দেওয়ার। এটুআই-এর সঙ্গে চুক্তি করেছি বিভিন্ন ভাতা এর মাধ্যমে দিতে।

/এইচএএইচ / এপিএইচ/