নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা, পণ্যের অস্বাভাবিক মজুদ ঠেকানোসহ সরবরাহ ঠিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত ১৪টি মনিটরিং টিম এখন পুরোপুরি অকার্যকর। নানা অজুহাতে এই কমিটি বর্তমানে কাজ করছে না। তাই আসন্ন রমজানে বাজার মনিটরিং সিস্টেম জোরদার করতে সরকার গঠিত বাজার মনিটরিং কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত কমিটিগুলোর প্রধান করা হয় সরকারের উপসচিব পদ মর্যাদার ১৪ জন কর্মকর্তাকে। যাদের অধিকাংশই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধিন সংস্থায় কর্মরত। এ সময়ের মধ্যে এই ১৪ জন কর্মকর্তার অনেকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয় বা দফতরে বদলি হয়ে গেছেন। কেউ পদোন্নতি পেয়েছেন, কেউ অবসরে গেছেন। আবার কেউ-কেউ অন্য মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা বাজার মনিটরিং কমিটিতে নেই। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ কমিটি প্রধানের পদ খালি। তাই কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সারাবছর বাজার মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত কমিটিতে উপসচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রতিটি কমিটির ছয় মাস করে বাজারে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করার কথা। প্রতিটি কমিটিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশিন ও ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সারাবছরের জন্য গঠিত এই ১৪টি মনিটরিং টিম গঠিত হলেও টিমগুলো মূলত কাজ করে রোজার সময়। অন্য সময় বাজার অস্থিতিশীল না হলে খুব একটা বাজার মনিটরিং করা হয় না।
আরও পড়তে পারেন: সবার জন্য বৈশাখী বোনাস বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবছে সরকার
বর্তমানে যে ১৪টি মনিটরিং কমিটি রয়েছে, সেগুলো গঠিত হয়েছে ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া এ কমিটির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। ১ জুলাই থেকে এমনিতেই দ্বিতীয় দফায় গঠিত নতুন কমিটির কাজ করার কথা। কাজেই এর আগে হয় নতুন কমিটি গঠিত হবে নতুবা কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে। এ কারণেই কমিটিগুলো পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ১৪টি মনিটরিং কমিটিতে প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুছ ছাত্তার শেখ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য পরামর্শক এ কে এম মাহমুদুল হাসান খান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কামরুল ইসলাম চৌধুরী, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) উপ-পরিচালক বেগম সাদিয়া হক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান বেলাল হোসেন মোল্লা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. যোবায়দুর রহমান, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সিনিয়র সহকারি প্রধান ইউসুফ আলী মজুমদার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শহীদুল ইসলাম, ইপিবির সহকারি পরিচালক এ কে এম ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের পরিচালক বেগম লায়লাতুন ফেরদৌস, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সিও মো. আক্তার হোসেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান মো. মোসলেহ উদ্দিন ও টিসিবির সিও আছির উদ্দিন সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কমিটিগুলো বাজার মনিটরিং করতে গিয়ে পণ্যের আমদানি, উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। প্রতিটি জেলায় জেল প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে গঠিত হবে বাজার মনিটরিং কমিটি। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীতে কমিটিগুলোকে প্রতিদিনের বাজার মনিটরিং শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জানা গেছে, এবারের রমজানে মনিটরিং কমিটিগুলোকে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কমিটি অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। প্রয়োজনে অবৈধ মজুদে হানা দিয়ে মজুদকৃত পণ্য অবমুক্ত করতে পারবেন বাজার মনিটরিং কমিটি। জানা গেছে, এবারও অতীতের মতো বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনে নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
আরও পড়তে পারেন: চেহারায় ইলিশ, আসলে ইলিশ নয়
রমজানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর, ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনও বাজার নিয়ন্ত্রণে চার-পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একাধিক মনিটরিং কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছেন ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য ভেজাল ও ফরমালিমুক্ত রাখতে ব্যবসায়ী এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের কঠোর নির্দেশও দেওয়া হবে এবার।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরকারি মনিটরিং না থাকার সুযোগে সুবিধাভোগী অসৎ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। বাজারে এত কিছু হচ্ছে তারপরও সরকারি কোনও তদারকি বা মনিটরিং নেই রাজধানীর বাজারগুলোয়। সরকারি মনিটরিং না থাকলে অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। সরকারি মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনও কারণ ছাড়াই বেড়েছে লবণ, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের দাম। এত কিছুর পরেও বাজারে যাচ্ছে না বাজার মনিটরিং কমিটি। কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সদর আলী বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, বাজার তো স্থিতিশীল। জিনসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তাই ওইভাবে আর সারাবছর বা সবসময় মনিটরিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মনিটরিং টিম পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক সময় বাজার অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যায় না। ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন পাওয়া যায় না। এ সব সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই মনিটরিং টিম পরিচালনা করতে হয়। তাই হয়তো নিয়মিত মনিটরিং করা সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বাজার স্থিতিশীল। নিত্যপণ্যের দাম জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। সামনে রোজা শুরু হচ্ছে। রোজাকে কেন্দ্র করে বাজার যেন অস্থিতিশীল না হয়, সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি য়েছে। আর বাজার অস্থির হলে অবশ্যই মাঠে মনিটরিং শুরু হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। এক কথায় সবই হবে। সাংবাদিকদের দিকে ইঙ্গিত করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা লিখে লিখে বাজার অস্থির করবেন না। বর্তমানে বাজারতো স্থিতিশীল।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেকোনও পণ্যের মজুদ শেষ হলে, সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। সিজন শেষ হয়ে যাওয়ায় মসুর ডাল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। এটা তো সাময়িক। তাই বলে তো ‘বাজারকে অস্থির’ বা ‘নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন’ এসব কথা বলা ঠিক হবে না। দেশের লোকজনতো ভালো আছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
আরও পড়তে পারেন: ৬৫ বছরেও স্থলবন্দরে রূপ পায়নি বাল্লা শুল্ক স্টেশন
এদিকে, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে। প্রতিবছরই এমনটি তারা করেন। এবার আগে থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এফবিসিসিআই।
এফবিসিসিআই বলছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আমদানিকারকদের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে সারাবছরই পর্যালোচন বৈঠক হয়। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আমদানি রফতানি নিয়ন্ত্রকের দফতর সূত্রের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে আছে। দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ১৪ লাখ ৫০ হাজার টন, মজুদ আছে ১৫ লাখ ৫১ হাজার টন, চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন, মজুদ আছে ১৬ লাখ ৩২ হাজার টন, পেঁয়াজের বাৎসরিক চাহিদা ২২ লাখ টন, মজুদ আছে ২৩ লাখ ৫৫ হাজার টন, রসুনের চাহিদা ৫ লাখ ২৭ হাজার টন, মজুদ আছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার টন, আদার চাহিদা ৩ লাখ টন, মজুদ আছে ৩ লাখ ৪ হাজার টন, মসুর ডালের চাহিদা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন, মজুদ আছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার টন, ছোলার চাহিদা ৬০ হাজার টন, মজুদ আছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টন, খেজুরের চাহিদা ১৫ হাজার টন, মজুদ আছে ১৭ হাজার টন। এ ছাড়াও ভোজ্যতেল আরও ২ লাখ টন বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে এবং পেঁয়াজ, রসুন ও আদা প্রতিদিনই আমদানি হচ্ছে। এছাড়া, এফবিসিসিআই প্রতিদিন দেশের পাইকারি বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি মনিটরিং করছে।
সরকার গঠিত মনিটরিং টিমকে সহায়তার জন্য প্রতিবছরই এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানানো হয় যাতে প্রত্যেক দোকানে পণ্য মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখেন এবং পণ্য ক্রয়ের রশিদ সংরক্ষণ করেন ও পাশাপাশি ভোক্তাদেরও পণ্য বিক্রির রশিদ দেন। এ ছাড়া, এফবিসিসিআই ভেজাল ও ক্ষতিকারক বা নকল পণ্য ও মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি না করার জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানায়। পর্যাপ্ত মজুদ এবং সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মূল্য বৃদ্ধির এ ধরনের অপতৎপরতা এফবিসিসিআই কোনও মতেই সমর্থন করে না এবং এ ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এফবিসিসিআই অনুরোধ জানায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে এ বছরও এসব অনুরোধ ও উদ্যোগ বহাল রাখবে বলে জানিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।
/এমএনএইচ/