অবশেষে সরকার সমর্থিত নতুন ৪ পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন ইসলামী ব্যাংকে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইসলামী ব্যাংকের একটি সূত্র। নতুন নিয়োগ পাওয়া পরিচালকরা হলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক(ভারপ্রাপ্ত) এম আযিযুল হক। এর আগে নতুন স্বতন্ত্র এই ৪ পরিচালকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ বৃহস্পতিবার সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বতন্ত্র ৪ পরিচালকের অনুমোদন পাওয়া গেছে। যাদের সবাই ব্যাংকিং খাতের পেশাদার ব্যক্তি। তিনি বলেন, পেশাদার ব্যক্তিরা পরিচালক হলে ব্যাংকের জন্য ভালো।
জানা গেছে, ৪ জনের মধ্যে সামীম মোহাম্মদ আফজাল ছাড়া বাকি তিন জনেরই ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমকে রূপালী ব্যাংকেও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। তিনি সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালক ছিলেন। এছাড়া হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও এম আযিযুল হক দুজনই সাবেক ব্যাংকার।
প্রসঙ্গত, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী যেকোনও ব্যাংকে চেয়ারম্যান বা পরিচালক নিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম অনুমোদন নিতে হয়। এরই অংশ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালকদের একটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। সেই তালিকায় কেউ ঋণ খেলাপি আছে কিনা, তারা পরিচালক হওয়ার যোগ্য কিনা কিংবা তাদের ব্যাংকের নীতি প্রণয়ন করার মতো সক্ষমতা আছে কিনা এসব বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বৃহস্পতিবার(৫মে) অনাপত্তিপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকেও এই ৪ জনের বিষয়ে অনাপত্তি নিতে হয়েছে।
নতুন ৪ পরিচালক নিয়োগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের জন্য এই নিয়োগ ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক যেন কোনও রাজনৈতিক দল দিয়ে পরিচালিত না হয় সেজন্য তারা ভূমিকা রাখবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এর ফলে ইসলামী ব্যাংক সাধারণ জনগণের ব্যাংকে পরিণত হবে।
জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের নাম সরাসরি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০-২৫ জনের নাম প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পেলেন ৪ জন।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন ৫ জন। তাদের মধ্যে ৪ জনকে বিদায় নিতে হয়েছে গত কয়েক মাসের মধ্যে। তারা হলেন, অধ্যাপক এন আর এম বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক ড. এ কে এম সদরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন ও মো.আবদুস সালাম। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই ৪ জনের মেয়াদ বাড়ানো থেকে বিরত থাকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। সরকারের পছন্দের নতুন ৪ স্বতন্ত্র পরিচালককে বসানোর জন্য তাদের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি বলে ব্যাংক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, পরিচালনা পর্ষদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংককে হাতের মুঠোয় নিচ্ছে সরকার।
সূত্রের দাবি, স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হুমায়ুন বখতিয়ার ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে থাকলেও অচিরেই তাকে বিদায় নিতে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন স্বতন্ত্র ৪ পরিচালককে অনুমোদন দেওয়া হয়। যদিও প্রায় দেড় বছর আগে থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তনের পক্ষে একটি বার্তা দেওয়া হয়। যার প্রভাব দেখা যায় বেশ কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে। পরিবর্তন আনা হয়, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদেও। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরের স্থানে বসানো হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে।
বিগত কয়েক বছর ধরে জঙ্গি অর্থায়ন ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থায়নের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। জামায়াতমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এই ব্যাংকটিকে জাতীয়করণের প্রস্তাব ছিল বিভিন্ন মহলের। গণজাগরণমঞ্চসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন, তরিকতপন্থী রাজনৈতিক দলেরও দাবি ছিল ব্যাংকটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার। বিষয়গুলো তদন্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আওতাধীন প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গত বছরের শেষের দিকে ভেতরে ভেতরে জামায়াতপন্থীদের গোল্ডেন হ্যান্ড শেকের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রদবদল করা হয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ছাড়া বাকি শীর্ষপদে। এদিকে আগামী ১৭ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিনি থেকে যাচ্ছেন ব্যাংকটিতে। তার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ইতিবাচক সিগন্যাল রয়েছে।
এদিকে, গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নির্বাহী উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। এমনকি বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ডিএমডি নুরুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশে শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সবচেয়ে বড়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পর্ষদে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। নির্বাহী ও নিচের পর্যায়েও ওই ঘরানার জনশক্তিই বেশি। ফলে ব্যাংকটি পরিচালিত হতো জামায়াতের আদর্শ নিয়ে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। ওই সময়ে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ছিল প্রথম ইসলামী ব্যাংক।
/এএইচ/
আরও খবর পড়ুন-
সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক: নিয়োগ পাচ্ছেন নতুন ৪ পরিচালক