X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

‘বিড়ি শিল্প চলছে শিশু দাসে’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:১৪আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:৪৬






বিড়ি ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে শিশুরা (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বাস্থ্যহানিকর কর্মখাতের তালিকায় বিড়ি ও তামাক শিল্পের নাম থাকলেও শিশুশ্রমের ওপর নির্ভর করেই চলছে বিড়ি শিল্প। রংপুর ও লালমনিরহাটের মতো জেলাগুলোতে দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের শিশুদের সস্তা শ্রমই বিড়ি কারখানাগুলোর টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন। এসব কারখানায় দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে পড়া হাজার হাজার শিশুকে খাটানো হয় দাসের মতো। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে এভাবেই মুনাফার মুখ দেখছে বিড়ি শিল্প।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) সম্পাদিত ‘International Journal of Behavioral and Healthcare Research’ জার্নালে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের এক গবেষণাপত্রে সম্প্রতি এই চিত্রই উঠে এসেছে।

‘Short-term (private) gains at the cost of long-term (public) benefits: child labour in bidi factories of Bangladesh’ শীর্ষক এই গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বিড়ি মালিকদের মুনাফা জোগানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে গোটা দেশের ভবিষ্যৎই সংকটের মুখে পড়ছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিড়ি ও অন্যান্য তামাক পণ্যে কর বাড়িয়ে ভোক্তা পর্যায়ে এগুলোর দাম বাড়াতে হবে। কার্যকরভাবে কর আরোপের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে বিড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা গেলেই কেবল বিড়ি কারখানাগুলো বাধ্য হবে নিজেদের উৎপাদন ও বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে। উৎপাদন হ্রাসের ধারাবাহিকতায় হ্রাস পাবে বিড়ি কারখানাগুলোর শ্রমশক্তিও। এভাবে বিড়ির চাহিদা ও সরবরাহ কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিড়ি শিল্পে অমানবিক শিশুশ্রম ব্যবহরের কার্যকর সমাধান করা যেতে পারে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে বিশেষ করে রংপুর ও লালমনিরহাটের দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোর শিশুরা এসব বিড়ি কারখানায় কাজ করে থাকে। প্রতিটি বিড়ি কারখানার ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ শ্রমিকই বয়সে শিশু। লালমনিরহাট জেলায় ২১ হাজার বিড়ি শ্রমিকের মধ্যে ১৫ হাজারই শিশু, যাদের বয়স ৪ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের আগে কোনও শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া অবৈধ।
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, সরকার ২০১৩ সালে মোট ৩৮টি কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, যেগুলো শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বাস্থ্যহানিকর। এই কর্মক্ষেত্রগুলোয় শিশুদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বিড়ি ও তামাক শিল্প। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শিল্পে এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্য পেশার শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান বিড়ি শিল্পের শ্রমিকেরা। বিড়ি ও জর্দা শিল্পে একজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের দৈনিক গড় মজুরি যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৮ টাকা। অন্যদিকে, একহাজার বিড়ির খোসা তৈরির জন্য একজন শিশুশ্রমিকের পারিশ্রমিক কোনোভাবেই ৭ থেকে ৮ টাকার বেশি হয় না।
বিড়ি কারখানায় কাজ করা শিশুরা বেশিরভাগই প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করতে পারে না। টাকা উপার্জনের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ ও কোম্পানির পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্টসংখ্যক বিড়ি তৈরি করার ভার মাথায় থাকার কারণে বেশিরভাগ শিশু শ্রমিকই স্কুলে যাওয়া বা খেলাধূলার কোনও সময় পায় না। শুধু তা-ই নয়, বিড়ি কারখানায় কাজ করা শিশু শ্রমিকদের প্রায়শই ক্রনিক ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, তলপেটের প্রদাহ, ডায়রিয়া ও পেশির ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়।
বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, তামাক পণ্যের দাম ১০ ভাগ বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের ভোক্তাদের মধ্যে এর ব্যবহার ৮ থেকে ১০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়।
২০১৮ সালেই ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষাণাপত্রে দেখানো হয়েছে, তামাক পণ্যের দাম ৫০ ভাগ বাড়লে গোটা বিশ্বে অন্তত ৬৭ মিলিয়ন পুরুষ তাদের ধূমপানের অভ্যাস ছেড়ে দেবেন। এই পুরুষদের বেশিরভাগই বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাসিন্দা। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) তামাক পণ্যের ওপরে অন্তত ৭০ শতাংশ করারোপের ওপর জোর দিয়েছে, যদিও বেশিরভাগ দেশই সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি।
জানা যায়, বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিড়ি কারখানাগুলোর বাইরেও ‘শিশুশ্রম নিষিদ্ধ’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। কিন্তু ভেতরে ঠিকই শিশুদের দাস হিসেবে পরিশ্রম করানো হয়ে থাকে। এই আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ নেই। তাই বিড়ি শিল্প থেকে শিশুশ্রমের মূলোৎপাটনের জন্য বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, স্কুলে শিশুদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারলে বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম কমবে। এ ক্ষেত্রে উপবৃত্তির আর্থিক মূল্য হতে হবে একজন শিশু শ্রমিকের অন্তত গড় মজুরির সমান।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শোষণ করেই টিকে আছে বাংলাদেশের বিড়ি শিল্প। বিড়ি শিল্পের মৃত্যুফাঁদে শিশুশ্রমের ব্যবহার কমাতে হলে শেষ পর্যন্ত এই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের কোনও বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন:


‘সিগারেটের আগে বিড়ি শিল্প বন্ধের ঘোষণা বৈষম্যমূলক’

 

/এসআই/টিআর/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রামে আরও তিন জনের করোনা শনাক্ত
চট্টগ্রামে আরও তিন জনের করোনা শনাক্ত
ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক!
ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক!
বিসিসিআইর গাইডলাইন অমান্য করেও শাস্তি পেলেন না জাদেজা
বিসিসিআইর গাইডলাইন অমান্য করেও শাস্তি পেলেন না জাদেজা
রাশিয়ার কাছে প্রথম স্বীকৃতি পেলো তালেবান
রাশিয়ার কাছে প্রথম স্বীকৃতি পেলো তালেবান
সর্বাধিক পঠিত
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল