X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের জঙ্গি অর্থায়নের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দারা

শফিকুল ইসলাম
০৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৪:৫১আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৮:২৯

জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জঙ্গি সম্পৃক্ততার খোঁজে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দলটির সংশ্লিষ্ট ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপরই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট তদন্ত শুরু করে।

গত ২২ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত-বিএনপি’র দুই শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে তালিকা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পরে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে ব্যাংক-বিমাসহ যেসব সেবামূলক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত ও শিবিরের কর্তৃত্ব রয়েছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কারও বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে।

জঙ্গি অর্থায়ন
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ কোনও নাশকতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া সুবিধাভোগীর ব্যাক্তিগত তথ্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সুবিধাভোগীরা কোন খাতে ব্যবহার করেছেন সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাহী পরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ইতিমধ্যেই দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সব শাখায় নজরদারি শুরু হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশেষভাবে নজরদারিতে রয়েছে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান নিজে বিষয়টি মনিটর করছেন। তবে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মূখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ বিষয়ে কাজ করছে ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআই)। বিষয়টির সঙ্গে আমরা অনেকেই সংশ্লিষ্ট নই। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে তদন্তের অগ্রগতি ও তদন্তের ধরন সম্পর্কে বলা ঠিক হবে না।

এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে বিএফআই ইউনিট। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার চাইলে যে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেকোনও ধরনের বিষয় খতিয়ে দেখতে পারে।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পৃথিবী জুড়েই তো এখন মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এধরনের অপরাধ নিরসনে পৃথিবীর সব দেশের সরকারেরই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারেরও এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ।’ সরকার এই কাজটিই করছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যদিও বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তারপরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে এতোবড় কাজটি করা সময় সাপেক্ষ। সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করা হচ্ছে বলে অনেক কিছুই বলা ঠিক হবে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। তারা খুঁটিনাটি দেখছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি এম ফরিদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, আমরাও নিজ ব্যাংকের সব শাখা ব্যবস্থাপকদের এ বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বলে দিয়েছি।  

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক, বিমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মাল্টি পারপাস সমিতিসহ ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠায় র‌্যাব-পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছেও। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগে থেকেই নজরদারিতে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছে, এ কাজের সঙ্গে দেশে কার্যত চারটি গোয়েন্দা সংস্থাও জড়িত রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কখনও নিজেরা আবার কখনও ব্যাংকের সহযোগিতা নেবেন।

সরকার মনে করছে, ওইসব প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন জামায়াত ও শিবিরকে অর্থ সহায়তা দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জামায়াত-শিবির সমর্থক বা কর্মীদের একটি বড় অংশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কাজে সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি এসব কর্মকর্তা জঙ্গি অর্থায়নসহ সরকারবিরোধী বা দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে বলেও মনে করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট পরিচালক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, ঠিকানা ও তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে জামায়াতের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ নজরদারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশে বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণকারী অন্য সরকারি সংস্থাগুলোকেও নজরদারি বাড়াতে বলা হয়। সে সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন সরকারের উদ্বেগের কারণ। তাই সংগঠনটির মালিকানাধীন ব্যাংক এবং লাভজনক সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি নিশ্চিত করা আবশ্যক।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে জামায়াত-শিবিরের দলীয় বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বৈদেশিক সাহায্যের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হয়েছে। সেসব অর্থ সংগঠনের পেছনে ব্যয় করার পাশাপাশি বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। 

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, আবাসন প্রতিষ্ঠান, পরিবহন কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, স্কুল-কলেজের কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিভিন্ন সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে বলে এর আগে গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে। তাদের কর্মকাণ্ডের ওপরও নজরদারি করা হচ্ছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ২০১৩ সালেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অর্থনীতিতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা যোগ হয়েছে। ওদের শুধু নিট মুনাফা ধরলেই অঙ্কটা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। যেটা বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে বেশি।

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া