মেডিটেশন বা ধ্যান স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক একটি মানসিক সেবা। আমাদের দেশে যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা ভ্যাটের আওতামুক্ত, সেহেতু মেডিটেশন সেবাকেও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা প্রয়োজন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট আরোপ করায় বিশিষ্টজনেরা নানা প্রতিক্রিয়ায় এমন আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, চিকিৎসকসহ রয়েছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষ।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রহুল হক সংসদে এবারের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন গত ২০ জুন। মেডিটেশনে ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেডিটেশনে ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে। সেটা কমিয়ে গতবারের (২০২১-২২) মতো জিরো করার জন্য আমি আহ্বান জানাই।’
১৯ জুন ঢাকা-৮ আসনের রাশেদ খান মেনন, এমপি তার বাজেট বক্তৃতায় প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘মেডিটেশনকে মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিধায় একে করের বাইরে রাখা প্রয়োজন। কোভিড প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মন যখন বিপর্যস্ত, সেখানে মেডিটেশনের আশ্রয় নিলে তাকে বেশি মূল্য দিতে হবে কেন, মাননীয় স্পিকার?’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, ‘যেখান থেকে মানুষের সেবা শুশ্রূষা বা সুস্থতার একটা পদ্ধতি করা হয় মেডিটেশন হচ্ছে— সেরকম একটা মাধ্যম বা পথ। এর ওপর সাধারণত কোনও ভ্যাট বা ট্যাক্স হওয়ার কথা না। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভলি এবং যৌক্তিকভাবে এটা রিভিউ করা দরকার।’
মেডিটেশন নিয়ে সারা পৃথিবীতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। গবেষকরাও বলছেন, নিয়মিত মেডিটেশনের কথা। শারীরিক-মানসিক সুস্বাস্থ্য অর্জনসহ সবদিক থেকে ভালো থাকার এই চর্চা মেডিটেশন বা ধ্যানের ওপর কর না নিয়ে এটিকে চিকিৎসা সহায়ক হিসেবে স্থায়ীভাবে ভ্যাটমুক্ত করার কথা জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমদ।
তিনি মনে করেন, নিয়মিত মেডিটেশন করলে একজন মানুষের মনোজগত ও দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর পরিবর্তন ঘটে। মানুষের প্রতি তার মমতা ও সমমর্মিতা বৃদ্ধি পায়।
ইউনাইটেড হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. জহির উদ্দিন আহমাদ বলেন, ‘মেডিটেশন হচ্ছে ইজ এ পার্ট অব ট্রিটমেন্ট, পার্ট অব রিলাক্সেশন এবং এটা শরীরের জন্য খুব প্রয়োজন এবং উপকারী। ট্রিটমেন্টের সঙ্গে আমরা মেডিটেশন এবং মেডিকেশন, ওষুধ এবং এই যোগ ব্যায়ামটাকে একসঙ্গে যোগ করে দেই। যাদের স্ট্রেস একটা বিরাট ফ্যাক্টর, তখন তাদেরকে বলেছি— ওষুধ ছাড়াও আপনারা মেডিটেশন প্র্যাকটিস করবেন। যদি ট্যাক্স ধরা হয়, তাহলে অনেকে এটা বাদ দিয়ে দেবেন। বাদ দিয়ে দিলে তাদের মানসিক ক্ষতি হবে।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, ‘একটা সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য যে একটা প্রক্রিয়া, তার ওপরে যে ভ্যাটটা আরোপ করা হয়েছে, এটার ফলে আমি বলবো— এখানে আগ্রহ যেটা আছে, সেটা কমে যাবে। আখেরে কিন্তু সোসাইটির মধ্যে যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় থাকার কথা, সেটি কিন্তু আমরা অনেক সময় পারবো না।’
কবি অসীম সাহা জানান, মেডিটেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত উপকার হয়, চিন্তা-চেতনার বিকাশও হয়। তাই মেডিটেশনের ওপর যেন কোনেও ভ্যাট আরোপ করা না হয়। এটা যদি বন্ধ করা না হয়, তাহলে এক্ষেত্রে যারা উদ্যোগ নিয়েছেন, শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের লাখ লাখ মানুষ। আমি মনে করি, আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী— তিনি মানবিক মানুষ এবং মানবিক কাজে তার ভূমিকা সর্বত্র নন্দিত। প্রধানমন্ত্রীরও এবিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি যদি হস্তক্ষেপ করেন, তবে এ ধরনের বৈপরীত্যমূলক কাজে যে ক্ষতি হয়, সে ক্ষতিটা অন্তত হবে না এবং বহু মানুষ উপকৃত হবে।’
২০২০-২০২১ অর্থবছর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘বৈশ্বিক এই দুর্যোগকালে জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবল অটুট রাখার স্বার্থে মেডিটেশন সেবার ওপর মূসক অব্যাহতি বলবৎ রাখার প্রস্তাব করছি।’ পরের বছরও তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি আরও এক বছরের জন্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।
মেডিটেশন চর্চার উপকার বিবেচনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মেডিটেশন সেবার ওপর প্রযোজ্য মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিলেন।
সবকিছু মিলিয়ে চলতি বাজেট বক্তব্যেও আলোচনায় ছিল মেডিটেশন। বাজেট বক্তৃতায় মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। তারা বলছেন, মেডিটেশন বা ধ্যান মানসিক স্বাস্থ্য সেবা হিসেবে বিবেচিত। স্বাস্থ্যসেবা যেহেতু ভ্যাটমুক্ত, তাই মেডিটেশনের ওপর থেকেও ভ্যাট প্রত্যাহার করাটা জরুরি। খুলনা-৫ আসনের নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি, বরিশাল-৪ এর সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ এমপি, গাজীপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ, ফেনী-১ আসনের শিরীন আখতারসহ আরও কয়েকজন সংসদ সদস্য তাদের বক্তব্যে মেডিটেশনের ওপর থেকে ভ্যাট স্থায়ীভাবে ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্যে প্রকাশিত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার গাইডলাইনে যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম চর্চার কথা বলা হয়েছে।