ক’দিন আগেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা কেজি দরে। সে সময় গো-খাদ্যের বেশি দাম, হাট ও পরিবহনে চাঁদাবাজির মতো নানা যুক্তি হাজির করতেন ব্যবসায়ীরা। গত এক সপ্তাহে কয়েক দফায় দাম কমে এখন বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা করে।
খামারি এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬০০ টাকা দামে গরুর মাংস বিক্রি করেও তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে না। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে গরুর উৎপাদন খরচ বিবেচনায় আরও কম দামে বিক্রি করলেও ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক লাভ থাকবে। ঢাকার আশপাশের কয়েকটি খামার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র দেখা গেছে।
খামারিরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গো- খাদ্যের দাম কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। সে সময় থেকে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে তারা হাইব্রিড ঘাস উৎপাদন শুরু করায় এখন গরু লালন-পালনের খরচ অনেকটা কমে এসেছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। কেরানীগঞ্জের ফারিহা মিনি ফার্মের স্বত্বাধিকারী ফজলুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দানাদার খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় এখন প্রতিটি গরু তারা সাত থেকে আট হাজার টাকা কমে বিক্রি করতে পারছেন।
রাজধানীর বাজারগুলোতে দেখা গেছে, গরুর মাংসের দোকানে এখন রীতিমতো দাম কমানোর প্রতিযোগিতা চলছে। কোনও দোকানে ৬৫০ টাকা দামে বিক্রি হলে পাশের দোকানে ক্রেতাদের ডেকে এনে ৬০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করছে। কোথাও কোথাও দোকানিরা দাম কমার সাইনবোর্ড লাগাচ্ছেন। এতে দোকানে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
বিক্রেতাদের মতে, বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাবে অতিরিক্ত মুনাফা করতে গিয়ে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর কারণে এখন তারা কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে এখন কম দামেই মাংস বিক্রি করছেন। তবে কম দামে বিক্রি করলেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদের কোনও লোকসান হচ্ছে না।
নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে মাংসের দোকানি শাইখুল ইসলাম জানান, এক সপ্তাহ আগেও দিনে দুটি বা তিনটি গরু জবাই করতেন তিনি। তখন দিনশেষে কিছু মাংস থেকে গেলেও এখন দাম কমার পর একই দোকানে প্রতিদিন চারটি গরু জবাই করা হয় এবং সন্ধ্যার আগেই তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। শাইখুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বেশি দামের কারণে ক্রেতারা মাংস কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ কারণে আমরা যতটা সম্ভব কম দামে বিক্রি করে পুনরায় ক্রেতাদের আকর্ষণ করছি। এ ছাড়া খামারিদের কাছ থেকেও এখন আমরা আগের চেয়ে কম দামে গরু আনতে পারছি।’
দাম কমে যাওয়ার কারণে লোকসান হচ্ছে কিনা, জানতে চাইলে হাতিরপুল বাজারের মাংস বিক্রেতা শুক্কুর মিয়া বলেন, ‘দাম কমায় আগের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বিক্রি বেড়েছে। এ ছাড়া গরুর দাম কমে আসায় লাভ আগের মতোই থাকছে।’ তার মতে, আরও কিছু দিন এমন থাকলে গরুর মাংসের দাম আরও কমবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরুর মাংসের চাহিদা বাংলাদেশে কখনও কম ছিল না। কিন্তু দাম ৭৫০ বা ৮০০ টাকা হয়ে যাওয়ার পর স্বল্প আয়ের মানুষদের পক্ষে তা নিয়মিত কেনা সম্ভব ছিল না। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকায় একটি শক্তিশালী চক্র অতি মুনাফা করতে মাংসের দাম বাড়িয়েছিল। এখন বিক্রি কমায় নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ফলে দাম কমিয়ে বিক্রি করছে। যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতেও তারা বাড়তি মুনাফা করছে।
কাউন্সিল অব ভোক্তা অধিকার বাংলাদেশ (সিআরবি) -এর সম্পাদক শাহ জালাল ভুঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বাজারে যখন গরুর মাংসের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে, সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ভোক্তারা যখন গরুর মাংস কেনা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে—এখন ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে দাম কমাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানি করলে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকার মধ্যে দাম রাখা সম্ভব। সেই হিসাবে ৬০০ টাকা বিক্রি করেও ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছেন।’
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ দাবি করছে—সরকারের নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের কারণেই গরুর মাংসের দাম কমেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গরুর মাংসের মূল্য ভোক্তাসহনীয় রাখতে কিছু দিন আগে আমরা ঢাকার বড় মাংস বিক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এ ছাড়া আমাদের মনিটরিং টিমের নিয়মিত কার্যক্রমের কারণেও বাজারে গরুর মাংসের দাম কমে এসেছে।’