বাংলাদেশের জন্য বড় এক মাইলফলক অপেক্ষা করছে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। জাতিসংঘ এরই মধ্যে বাংলাদেশকে উত্তরণের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অনেক কাঠামোগত দুর্বলতা, বৈষম্য, প্রস্তুতির ঘাটতি ও আমলাতান্ত্রিক ধীরগতির কারণে এই অর্জন হয়তো মানুষকে বাস্তবে তেমন সুবিধা দিতে পারবে না।
উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা মানে কী
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ মানে হলো—একটি দেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং অবকাঠামোগতভাবে উন্নত হয়েছে—এমন একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি দেশের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু এর কিছু বড় চ্যালেঞ্জও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—এই উত্তরণের পর বাংলাদেশ অনেক ধরনের আন্তর্জাতিক সুবিধা হারাবে। যেমন- ইউরোপ, কানাডা ও জাপানের বাজারে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আইনে ছাড়, বাণিজ্য সহায়তা ও অনুদানমূলক ঋণ পাবে না।
এই সুবিধাগুলো হারালে বাংলাদেশকে নিজেদের রফতানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এই প্রস্তুতি কতটা হচ্ছে, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে।
কেন উদ্বেগ বাড়ছে?
১. এক পণ্যের ওপর বেশি নির্ভরতা: বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক (গার্মেন্টস) খাত থেকে। যদি এই খাতে কোনও সমস্যা হয় বা প্রতিযোগিতা বাড়ে, তাহলে অর্থনীতি বড় ঝুঁকিতে পড়বে। অন্য খাতগুলো এখনও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি।
২. অনির্দিষ্ট শুল্কনীতি: অর্থনীতিবিদ ড. এম এ রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনও সুস্পষ্ট শুল্কনীতি ঘোষণা করতে পারেনি। অথচ পাকিস্তান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে—তারা সব পণ্যের শুল্ক ৯-১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে যাবে।
৩. নানা খাতে দুর্বলতা: শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা কম, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজস্ব আদায় কম, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, বৈদেশিক ঋণের চাপ।
৪. বৈষম্য ও মূল্যস্ফীতিতে জনজীবন চাপে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২০ মার্কিন ডলার। আগের বছরের তুলনায় যা কিছুটা বেশি। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট বলছে— এ প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পাচ্ছে না। আয় বেড়েছে কাগজে, কিন্তু বাস্তবে মানুষের খরচ বেড়েছে আরও বেশি।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আগের মতো বাজার করতে পারছে না। ফলে বাস্তব আয় কমে যাচ্ছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও বাড়ছে।
কী হতে পারে উত্তরণের পর?
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। তখন দেশের রফতানিকারকদের বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। অনেক দেশ এমন সুযোগ হাতছাড়া করে ধাক্কা খেয়েছে।
তবে বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই প্রস্তুতি না নেয়, তাহলে এই উত্তরণ শুধুই একটি মর্যাদা হিসেবে গণ্য হবে—মানুষের জীবনে কোনও পরিবর্তন আনবে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধা বাড়তে পারে।
সরকার কী করছে?
সরকার ‘স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘সুশৃঙ্খল উত্তরণ কৌশল’ গ্রহণ করেছে। এই কৌশলের আওতায় রয়েছে নতুন বাজার খোঁজা, রফতানি খাত বৈচিত্র্য করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, ব্যবসা পরিবেশ সহজ করা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। এসব পরিকল্পনা আছে ঠিকই, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘কাগজে থাকলে হবে না, বাস্তবায়নই আসল কাজ।’
বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণে এখনও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু।
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকখানি অগ্রসর হয়েছি। অর্থনীতির নানা সূচকে আমাদের উন্নয়ন দৃশ্যমান। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। আপ টু দ্য মার্ক বলা যাবে না, অর্থাৎ পুরোপুরি প্রস্তুত নই। যদি উত্তরণটি ২০২৬ সালের পরিবর্তে আরও দুই-তিন বছর পর হতো, তাহলে আরও ভালো প্রস্তুতি নেওয়া যেতো।’
এ সময় এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প খাতের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা) থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের দাবি। কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক উৎপাদন কাঠামো দিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবো না।’
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলেও এই উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের জন্য দেশের ব্যবসায়ীরা এখনও পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নয় বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সুবিধা হারাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে রফতানি খাতে। এখন যেসব দেশে আমরা শুল্কমুক্ত বা রেয়াতি সুবিধায় পণ্য পাঠাতে পারি, উত্তরণের পর সেসব সুবিধা আর থাকবে না। এতে বাংলাদেশের রফতানিতে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু রফতানি নয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কমে আসতে পারে। উন্নয়ন সহযোগীরা আর আগের মতো অনুদান বা সহজ শর্তে অর্থায়ন করবে না।’
অর্থনৈতিক তথ্য নিয়ে প্রশ্ন
বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সময় প্রকাশিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘গত সরকারের সময় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনেকটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও গোঁজামিলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। বাস্তবচিত্র থেকে সেসব অনেক দূরে।’
অবশ্য বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের পথে উত্তরণকে সামনে রেখে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গত ১১ মে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন কমিটির এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন একটি দল দরকার, যারা অগ্নিনির্বাপক দলের মতো যেকোনও পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দিতে পারবে এবং সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবে।’
প্রধান উপদেষ্টা জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন অংশীদারদের মনোযোগ পেয়েছি। এখন জরুরি হচ্ছে কার্যকরভাবে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।’
তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে উত্তরণের প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
অগ্রাধিকার ৫ পদক্ষেপ
বৈঠকে পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়—১. জাতীয় সিঙ্গেল উইন্ডো পুরোপুরি চালু করা, ২. জাতীয় শুল্ক নীতি ২০২৩ বাস্তবায়ন, ৩. জাতীয় লজিস্টিকস নীতি ২০২৪ অনুযায়ী অবকাঠামো উন্নয়ন, ৪. সাভার ট্যানারি ভিলেজে ইটিপি স্থাপন ও চালু রাখা এবং ৫. গজারিয়ায় এপিআই পার্ক চালু করে ওষুধ খাত শক্তিশালী করা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই কাজগুলো রুটিন নয়, বরং উত্তরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
এর আগে ১৫ এপ্রিল আরেক বৈঠকে ড. ইউনূস সতর্ক করে বলেন, ‘উত্তরণ চূড়ান্ত। এখন বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে।’