বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে বিবেচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন কার্যত অচল। আন্দোলনরত রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে পৌঁছার পরও সংকট নিরসনের আলোচনায় কোনও অগ্রগতি হয়নি—বরং পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রবিবার (২৯ জুন) বিকালে একটি বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাফ জানিয়ে দেন, ‘আন্দোলন চলাকালে বৈঠকের সুযোগ নেই।’ ফলে ১ জুলাইয়ের বৈঠক নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
অপরদিকে আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা পাল্টা সুরে জানিয়ে দিয়েছেন—‘‘দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সরকার একতরফা ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে পারবে না।’’
এই ‘অচলাবস্থা’ এখন আর কেবল এনবিআরের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়—দেশের সামগ্রিক রাজস্ব আহরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা ও বিনিয়োগ পরিবেশ—সবই হুমকির মুখে।
চেয়ারম্যান অপসারণসহ বিস্তৃত প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিতে কাস্টমস ও শুল্ক কর্মকর্তাদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেও দেশের প্রধান প্রধান বন্দরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে আখাউড়া, বেনাপোল, ভোমরা, বুড়িমারী ও হিলি—সব কাস্টমস হাউজেই কার্যক্রম বন্ধ থাকায় থমকে গেছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। এতে পণ্যজট, শিপমেন্ট বিলম্ব, এলসি নিষ্পত্তি বিঘ্ন এবং রাজস্ব আয় স্থগিতসহ নানাবিধ সংকট একযোগে ঘনীভূত হচ্ছে।
বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অচলাবস্থার ফলে দেশের অর্থনীতির প্রধান চক্র—রফতানি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। দৈনিক গড় হিসাবে বন্দরে প্রায় ৬০০-৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। সেই হিসাবে মাত্র দুই দিনে ক্ষতির পরিমাণ ১৫০০ কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থলবন্দরে স্থবিরতা
বেনাপোলে ৮০০ ট্রাক, আখাউড়ায় ১১ কোটি টাকার রফতানি আটকে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে বিল অব এক্সপোর্ট ও বিল অব এন্ট্রি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকায় অন্তত ১১ কোটি টাকার রফতানি কার্যক্রম থমকে গেছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে, ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তে আটকে আছে ৮০০-এর বেশি পণ্যবোঝাই ট্রাক। কাস্টমস শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় পণ্য খালাস, পরীক্ষা বা ছাড়ের কোনও কার্যক্রমই সম্ভব হচ্ছে না।
ভোমরা বন্দরে প্রতিদিন এক কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হলেও দুই দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকায় ভারত-বাংলাদেশ উভয়মুখী ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ।
বুড়িমারী ও হিলি বন্দরে একই চিত্র। শত শত ট্রাক বন্দরে অবস্থান করলেও কোনও খালাস হয়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির, প্রতিদিন ক্ষতি ২৫০০ কোটি টাকা
এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশের সব বন্দর, কাস্টম হাউজ, ভ্যাট কমিশনারেট এবং কর অঞ্চলগুলোতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের অভ্যন্তরে আটকে আছে অন্তত ৩৬৮০টি রফতানি কনটেইনার, যার বেশিরভাগে আছে তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্য।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স বলছে, এভাবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি রফতানি ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত।
শিল্প উৎপাদনে ধস, শ্রমিক বেতন অনিশ্চয়তা
রাজস্ব সনদ, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ইউটিলিটি অনুমোদন, পণ্য ছাড়পত্র—এসব কার্যক্রম না হওয়ায় শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পোশাক, চামড়া, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন রফতানিমুখী খাতে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানান, এভাবে চললে প্রতি সপ্তাহেই বহু কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে। তিনি বলেন, ‘পোশাক খাতে প্রতিদিন ২৫০০ থেকে ২৬০০ কোটি টাকার কার্যক্রম থেমে যাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা শিপমেন্ট বিলম্বিত হওয়ায় চুক্তি বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন। হারানো বাজার ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘কাঁচামাল না এলে শিল্প ধসে পড়বে। বৈদেশিক ক্রেতারা অনেক ক্ষেত্রে চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে গুরুতর ধাক্কা লাগছে।’
রাজস্ব আহরণে ধস: জুন মাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা
জুন মাস সাধারণত সরকার রাজস্ব আদায়ের চূড়ান্ত মাস। কিন্তু আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন গড়ে ২০০-২৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা কর্মস্থলে না থাকায় বড় পরিসরে শুল্ক ফাঁকি, চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকির ঝুঁকি বাড়ছে। জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে এনবিআর যে ভূমিকা রাখে—তাতে এই অচলাবস্থা সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাজেট ঘাটতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, ‘এই রাজস্ব সংকট সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন খাতের অর্থায়নে বড় আঘাত আনতে পারে।’
বাজারে সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির হুমকি
কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি আটকে থাকায় নিত্যপণ্য, ওষুধ ও শিল্পপণ্যের সরবরাহ চেইন হুমকির মুখে পড়েছে। বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিলে মূল্যবৃদ্ধির নতুন ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে, যা সাধারণ ভোক্তাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বিপন্ন, বিদেশি বিনিয়োগে সংকট
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধাবস্থার বাইরেও কোনও দেশে কাস্টমস কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকা নজিরবিহীন। এটি বাংলাদেশের ট্রেড র্যাংকিং ও আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে নেতিবাচক প্রতিফলন ফেলবে।’
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রশাসনের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সংকট নিরসনে সরকারের উদ্যোগ
সংকট মোকাবিলায় সরকার পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটিতে সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
এছাড়া, এনবিআরের আওতাধীন সব কাস্টমস, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘জাতীয় স্বার্থে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত কর্মস্থলে ফিরে আসা উচিত। অন্যথায়, সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।’
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক: সমঝোতার পথ খুঁজছে সরকার
রবিবার বিকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইসিসিবি, এফবিসিসিআই, এলএফএমইএবি, বিজিএমইএ, বিসিআইসহ ১২টি সংগঠনের শীর্ষ প্রতিনিধি। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সংকটের কেন্দ্রবিন্দু: এনবিআর বিলুপ্তি ও প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃত্ব
২০২৫ সালের ১২ মে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ—‘রাজস্ব নীতি’ এবং ‘রাজস্ব প্রশাসন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের মধ্য দিয়ে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে আনার অভিযোগে রাজস্ব কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ দাবি করছে, এতে তাদের মর্যাদা, পদোন্নতি, স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। তারা পরিষ্কারভাবে ‘বিলুপ্তি প্রত্যাহার’ এবং ‘চেয়ারম্যানকে অপসারণ’ দাবি করছে।
অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়াতে দ্রুত সমঝোতা দরকার
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট শুধু রাজস্ব আদায়ে নয়— সমগ্র অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক অভিঘাত তৈরি করছে। রফতানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও চাপে পড়বে। রাজস্ব আদায় না হলে বাজেট বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন ব্যয় হুমকিতে পড়বে। শিল্প স্থবির হলে কর্মসংস্থান কমবে। আর দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।
এই পরিস্থিতিতে একপক্ষের অনমনীয়তা ও অন্যপক্ষের জিরো টলারেন্স নীতি—উভয়ই সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। এখনই দরকার দ্রুত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পরিপক্বতা ও গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো, যা রাজস্ব কর্মকর্তাদের উদ্বেগেরও সমাধান করবে এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও সচল করবে। যত দেরি হবে, তত মূল্যবান সময় এবং বিপুল অর্থনৈতিক শক্তি হারাবে বাংলাদেশ।