X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেপ প্রোপাগান্ডা: নারীর শরীর যখন বর্ণবাদী ঘৃণার জ্বালানি

ইরফানুর রহমান রাফিন
২৬ জুন ২০২০, ১৮:০৬আপডেট : ২৬ জুন ২০২০, ১৯:৪৯

ধর্ষণ মানবসমাজের সবচেয়ে প্রাচীন অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। ইতিহাসজুড়ে মূলত মেয়েরাই এর শিকার, তবে ক্ষেত্রবিশেষে অল্পবয়সী ছেলেরা এবং প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরাও। ধর্ষণের উৎস মানব প্রকৃতির কোনও অন্ধকার অঞ্চলে নিহিত নাকি এটা সামাজিক অন্যায্যতার বিভিন্ন কাঠামো থেকে উৎসারিত, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে সম্ভবত সামাজিক দিকটাই প্রধান (১)।  ছবি সূত্র: দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল

আজকের দুনিয়ায় ধর্ষণ সর্বত্রই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। যদিও বাংলাদেশের মতো অল্প কয়েকটি দেশে বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে সংঘটিত ধর্ষণকে (ম্যারিটাল রেপ) এখনও ক্রিমিনালাইজ করা হয়নি (২)। যা-হোক, এই লেখার বিষয়বস্তু আসলে ধর্ষণ নয়। আমার এই লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে ধর্ষণ সংক্রান্ত প্রোপাগান্ডা (রেপ প্রোপাগান্ডা)। 

রেপ প্রোপাগাণ্ডাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়: বাস্তব বা কাল্পনিক ধর্ষণের ঘটনা যদি কোনও বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়, অথবা কোনও বিশেষ মানবগোষ্ঠীর পুরুষদের ঢালাওভাবে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে সেটি রেপ প্রোপাগান্ডা হিসেবে বিবেচিত হবে। 

টারজানে আমরা দেখি, সাদা নারী অসংখ্যবার হারিয়ে যাচ্ছে গহীন জঙ্গলে, দেখতে জন্তুসদৃশ কালো পুরুষ আক্রমণ করছে তাকে। ত্রাতা হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হচ্ছে সাদা পুরুষ, ঠেকিয়ে দিচ্ছে সাদা নারীর সম্ভাব্য ধর্ষণ। এটা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার একটা অদ্ভুত রিভার্সাল, যেখানে সাদা দাসমালিকরাই ধর্ষণ করতো কালো মেয়েদের।

এটাকে আমরা বলতে পারি ব্ল্যাক রেপিস্ট প্রোপাগান্ডা।

বাস্তবে এই প্রোপাগাণ্ডার সামাজিক প্রভাব কত ভয়াবহ, তার করুণতম উদাহরণ এমেট টিল হত্যাকাণ্ড। ১৯৫৫-তে ২১ বছর বয়সী ক্যারোলিন ব্রায়ান্ট নামে এক সাদা আমেরিকান নারী মুদি দোকানদার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, ১৪ বছর বয়সী কালো আমেরিকান কিশোরটি তার কোমর জড়িয়ে ধরে নিপীড়নমূলক মন্তব্য করেছিল, যার 'প্রতিক্রিয়ায়' এর কিছু দিন পর ওই নারীর জামাই ও জামাইয়ের সৎভাই কিশোরটিকে খুন করে। বহু বছর পর ব্রায়ান্ট আক্ষেপ করে বলেন, ওই অংশটুকু মিথ্যা ছিল, তিনি তার পুরুষ আত্মীয়দের খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে নিহত কিশোরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন (৩)।

এটা হচ্ছে রেপ প্রোপাগান্ডার একটা টেক্সটবুক এগজাম্পল।

নাৎসি জার্মানিতেও ইহুদিদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ঘৃণা ছড়ানোর একটা মোক্ষম হাতিয়ার ছিলো রেপ প্রোপাগাণ্ডা। এই প্রোপাগাণ্ডা অনুসারে, ঢালাওভাবে ইহুদি পুরুষদেরকে জিউইশ ধর্ষক বলা হত, যারা আর্য নারীর ধর্মনাশ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, জেন্টাইল জার্মান নারীর দেহ আর্য জাতির ধারকবাহক, ইহুদি পুরুষের ছোঁয়ায় সেই দেহ 'কলুষিত' হয়। ইহুদি পুরুষরা 'সহজসরল' আর্য নারীদের 'প্রলুব্ধ' করে। তাদের গর্ভে জন্ম দেয় 'নোংরা' ইহুদি রক্ত। এর ফলে 'দুর্বল' হয়ে পড়ে আর্য জাতি। তাই 'নিশ্চিহ্ন' করে ফেলতে হবে এই ইহুদিদেরকে, রক্ষা করতে হবে নারী ও জাতি।

হলোকাস্ট হঠাৎ করে শুরু হয় নাই, ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিদের ছড়ানো এই ধরণের বর্ণবাদী ঘৃণা কনসেনট্রেশান ক্যাম্পগুলো তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকে ইহুদিদেরকে বিমানবীকরণ (ডিহিউম্যানাইজ) করার কাজটি শুরু করেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চারু গুপ্তা ২৮ আগস্ট ২০১৪ সালে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় The myth of love jihad নামে একটি কলাম লেখেন (৪)। তাঁর বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, তথাকথিত লাভ জিহাদ আসলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্টদের রেপ প্রোপাগাণ্ডা। এটা নাৎসি জার্মানির জিউইশ রেপিস্ট ধারণার একটা উপমহাদেশীয় রূপ, এর ভিত্তিও পিতৃতন্ত্র, স্রেফ আর্য নারীর জায়গায় হিন্দু নারী আর ইহুদি পুরুষের জায়গায় মুসলমান পুরুষ বসিয়ে নিলেই হবে।

সমকালীন পশ্চিমেও উগ্র ডানপন্থীরা রেপ প্রোপাগান্ডা চালায়।

পোলিশ ম্যাগাজিনে রেপ প্রোপাগান্ডা

এই প্রোপাগান্ডায় ইউরোপ এক বিপন্ন শাদা নারী, যাকে আক্রমণ করছে আরব অভিবাসী অভিবাসীরা। মাঝখানে জার্মানিতে যখন যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছিলো, তখন উগ্র ডানপন্থীরা রটিয়ে দিয়েছিলো, আরবরা নাকি মেয়েদের সাথে তাহাররুশ নামক রেপ গেম খেলে। জার্মানিতে বিলবোর্ডে আর পোল্যান্ডে পত্রিকার কাভারে এই ভয়াবহ প্রচারণাটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যা নিঃসন্দেহে আরবদের প্রতি বর্ণবাদী ঘৃণা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের পিএইচডি পর্যায়ের ইরানি-আমেরিকান ছাত্র অ্যালেক্স শামস ২১ জানুয়ারি ২০১৬ সালে হাফিংটন পোস্টে Neither Taharrush Gamea Nor Sexism Are Arab 'Cultural Practices' নামে একটি কলাম লেখেন (৫)। সেখানে তিনি এই রেপ প্রোপাগান্ডার ভিত্তিহীনতাকে তুলে ধরেন। দেখান, দুনিয়ার সব সমাজের মতো আরব সমাজও পিতৃতান্ত্রিক, সেখানেও মেয়েরা নানাপ্রকার জুলুমনিপীড়নের শিকার হয়, তবে তাহাররুশের ধারণাটা কাল্পনিক।

Post-truth is pre-fascism. কথাটা লিখেছেন টিমোথি স্নাইডার, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের হুসাম অধ্যাপক, জীবিত হলোকাস্ট স্কলারদের মধ্যে অন্যতম সেরা বলে বিবেচিত। রেপ প্রোপাগান্ডার সামাজিক প্রভাব সবসময়ই ভয়ানক ছিলো, এই পোস্ট ট্রুথের কালে, তার প্রভাব নৃশংসতর হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

জার্মান বিলবোর্ডে রেপ প্রোপাগান্ডা

রেপ জঘন্য ক্রাইম। যেকোনো মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই রেপের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু রেপের বিরোধিতা করা এক কথা, রেপ প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে কোনো মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ঘৃণা ছড়ানো সম্পূর্ণ ভিন্নকথা।

নারীদেহ যেনো বর্ণবাদী ঘৃণার জ্বালানি না হয়।

তথ্যসূত্র

(১) ব্রাউনমিলার রেপকে পুরুষতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত করে দেখিয়েছেন। থর্নহিল আর পামার এই দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং রেপের উৎস খুঁজে পেয়েছেন বিবর্তনীয় মনস্তত্ত্বে, যদিও কোনোকিছু ন্যাচারাল হলেই সেটাই মোরালি গ্রহণযোগ্য হবে, তারা এই ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসিরও বিরোধী। দেখুন, Brownmiller, S. (1993) Against Our Will : Men, Women, and Rape. Fawcett Books. এবং Thornhill, R., & Palmer, C. T. (2000). A natural history of rape: Biological bases of sexual coercion. The MIT Press.

(২) ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে প্রণীত ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের সেকশন ৩৭৫ রেপকে জেনারেলি ক্রিমিনালাইজ করলেও তার exemption অংশ পরিষ্কারভাবে বলছে, "Sexual intercourse by a man with his own wife, the wife not being under thirteen years of age, is not rape." এভাবে ম্যারিটাল রেপ একটা আইনি বৈধতা পেলো। এই প্রসঙ্গ নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন, Huda, Takbir, 'Why is marital rape still legal in Bangladesh?', The Daily Star, published on 26 July 2017, accessed on 19 June 2020, available online: https://www.thedailystar.net/opinion/society/why-marital-rape-still-legal-bangladesh-1438600

(৩) https://en.m.wikipedia.org/wiki/Emmett_Till. এমেট টিল হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি, পরিবার ৬৫ বছর ধরে অপেক্ষা করছে। দেখুন, Pilkington, Ed, 'Will justice finally be done for Emmett Till? Family hope a 65-year wait may soon be over', The Guardian, published on 25 April 2020, accessed on 19 June 2020, available online: https://www.theguardian.com/us-news/2020/apr/25/emmett-till-long-wait-for-justice

(৪) https://indianexpress.com/article/opinion/columns/the-myth-of-love-jihad/

(৫) https://www.huffpost.com/entry/sexism-isnt-an-arab-cultural-practice_b_9022056

 লেখক: অনুবাদক ও গবেষক। ইমেইল যোগাযোগঃ [email protected]

/বিএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়