X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘শুধু ওসি আমাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন’

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর
০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০০আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ২২:৫১

 

সুলতান রুবাইয়াত আকন্দ সুমন বুড়িমারীতে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার গুজব তুলে রশিদুন্নবী জুয়েলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার প্রকৃত ঘটনা দীর্ঘদিন পর জানিয়েছেন জুয়েলের সঙ্গী  সুলতান রুবাইয়াত আকন্দ সুমন। তার অভিযোগ পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন মসজিদের খাদেম জাবেদ আলী, ডেকোরেটর মালিক হোসেন আলী এবং স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম। তারাই মিথ্যা গল্প বানিয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছে। নিজেও অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সুমন। তিনি অভিযোগ করেন, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। শুধুমাত্র ওসি তাদের বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। এসময় তিনি জানিয়েছেন তাকে উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার কথা।

বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিনের পুরো ঘটনা তুলে ধরেন।

সুমন রংপুর নগরীর মুন্সীপাড়া কবরস্থান সড়কের অধ্যক্ষ আব্বাছ আলীর দ্বিতীয় ছেলে। সেদিনে সেই হামলা ও নির্যাতনের পর তিনি এখন প্রচণ্ড অসুস্থ। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসাও প্রায় বন্ধ হয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সুমন জানান, নিহত জুয়েল তার বাল্যবন্ধু। তারা দু’জনেই রংপুর জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। পরে জুয়েল রংপুর কারমাইকেল কলেজে আর তিনি রংপুর কলেজে পড়া শোনা করেন। এইচএসসি পাসের পর জুয়েল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। আর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তার আর লেখাপড়া হয়নি।

সেদিন যা ঘটেছিল: সুমন জানান ২৯ অক্টোবর জুয়েল তাকে ফোন করে বুড়িমারী যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে রাজি হন সুমন। সকাল ১০ টার দিকে জুয়েল তার মোটরসাইকেল নিয়ে সুমনের বাড়িতে আসেন। এরপর তারা দু’জনেই লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও বুড়িমারীতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। যেতে যেতে জুয়েল জানায় তার বড় বোন লিপি আপার সঙ্গে দেখা করে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুলের বাড়িতে যাবে। সেখানেই খাওয়া দাওয়া করে দেখা করে সন্ধ্যার মধ্যে রংপুরে ফিরবে।

কিন্তু বুড়িমারীতে পৌঁছার পর আছরের নামাজের সময় হলে নিহত জুয়েল ও তিনি বুড়িমারী মসজিদে নামাজ পড়তে যান। সুমন জানান, তার মোবাইলফোনে চার্জ না থাকায় সে মসজিদের পাশে একটি দোকানে ফোন চার্জ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ওযু করে মসজিদে যান। তবে দেরি হওয়ায় ভেতরে জায়গা না পেয়ে তিনি মসজিদের বারান্দায় নামাজ আদায় করেন।

সুমন জানান, নিহত জুয়েল মসজিদের ভেতরে নামাজ আদায় করার পরেও ১৫ মিনিট ধরে বের না হওয়ায় তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। এসময় তিনি দেখেন মসজিদে জুয়েলের সঙ্গে খাদেম জাবেদ আলী, ডেকোরেটর মালিক হোসেন আলী ও ইউপি মেম্বার হাফিজুল ইসলামের বাকবিতণ্ডা চলছে। মসজিদের ভেতরে জুয়েল কি করেছে তা তিনি জানতেন না। অন্যরা শুধু কোরআন শরীফের অবমাননা হয়েছে বলছিলো বলে জানান তিনি। এ সময় সুমন নিজেই তাদের কাছে হাত জোর করে কয়েকদফা মাফ চান। কিন্তু তারা কোনও কথাই শুনছিলেন না। এক পর্যায়ে ১৭-১৮ বছরের এক যুবক স্যান্ডেল দিয়ে তার মুখে আঘাত করে। এরপর ইউপি মেম্বার তাকেসহ নিহত জুয়েলকে শার্টের কলার ধরে মারতে মারতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে আটকে রাখে।

তিনি বলেন, এরপর ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়তে থাকে। এ সময় আমাদের দু’জনকে গণপিটুনি দেওয়া শুরু হয়। কেউ জুতা, কেউ স্যান্ডেল, যে-যা পেয়েছে তা দিয়ে তাদের পিটুনি দেয়। এ সময় একটি বাঁশ দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করলে রক্ত বের হতে থাকে। আমাদের সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়। আবারও জুয়েল ও আমার মাথায় আঘাতের পর আঘাত চলতে থাকে।

সুমন বলেন, খবর পেয়ে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত দু’জন পুলিশ সদস্য নিয়ে সেখানে আসেন। এর মধ্যেই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের আশপাশে হাজারও মানুষ জমায়েত হয়।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার সময় পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান বাবলুকে ফোন করতে বলি। ততক্ষণে জুয়েলের ফোন কে বা কারা নিয়ে গেছে। আর আমি জীবনের প্রথম বুড়িমারীতে এসেছি, আমার কাছে তার ফোন নম্বর ছিল না। আমরা দু’জনেই বলেছি উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন, তিনি আমাদের চেনেন। কারণ জুয়েল তার আত্মীয়। কিন্তু কেউ সে কথা শোনেনি। এ সময় পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত জুয়েল আর আমাকে উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করেন। তিনি নিজেও আহত হন এ সময়। এক পর্যায়ে সম্ভবত বিজিবি ফাঁকা গুলি চালালে লোকজন সরে যায়। এ সুযোগে ওসি জুয়েল ও আমাকে নিয়ে বাইরে আসার চেষ্টা করলেও জুয়েলকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাকে তিনি পাশের একটি দোতলা ভবনের ছাদে নিয়ে যান। সেখানেও আমাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য দোতলার কলাবসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করা হয়। পরে ওসি দোতলা থেকে আমাকে নিয়ে পাশের একটি টিনের চালে ঝাঁপ দেন। এরপর আমাকে কখন পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেছে আমি জানি না। সেখানে ছয় দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর পুলিশি পাহারায় আমাকে রংপুরে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সুমনের অভিযোগ, ‘মসজিদের ভেতরে ঘটনার তিন নায়ক মসজিদের খাদেম জাবেদ আলী, ডেকোরেটর মালিক হোসেন আলী আর ইউপি মেম্বার হাফিজুল ইসলাম। যেহেতু ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলাম, তারা বিষয়টি সমাধান করতে পারতেন। তবে তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে জঘন্য ঘটনা ঘটান।’

তিনি বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। শুধুমাত্র ওসি আমাদের বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।’

সুমন জানান, তার মাথায় ও শরীরে আঘাতের কারণে প্রচণ্ড ব্যথা রয়েছে। ডাক্তার তাকে বিশ্রামে থাকতে বলেছে। সেইসঙ্গে পুরো শরীরের এমআরআইসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছে। তবে টাকার অভাবে তার এখন চিকিৎসা বন্ধ বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সন্তানের জন্য হলেও আমি বাঁচতে চাই। তাদের লেখাপড়া করাতে চাই, আবারও কাজে ফিরতে চাই। তার চিকিৎসার জন্য হৃদয়বান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সুমন।

 

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত