X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট-স্বপ্ন ‘নিষিদ্ধ’ জেনেও ক্রিকেটেই মারুফার বসবাস

রবিউল ইসলাম
১৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:১১আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৯:৩৪

সৈয়দপুর-নীলফামারী সড়কের সঙ্গে লাগোয়া ঢেলাপীর হাট। সেই হাট থেকে খানিক দূরে মারুফা আক্তারদের বাড়ি। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মারুফার কৃষক বাবা মোহাম্মদ আইমুল্লার কঠিন জীবন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেও দুই ছেলে ও এক মেয়ের ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে পরিশ্রম বেশিই হয়ে যাচ্ছে আইমুল্লার। এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে হতদরিদ্র বাবার কাজে সাহায্য করার বদলে ক্রিকেট খেলার সৌখিনতার স্বপ্ন দেখাটা অন্যায় মনে হয় মারুফার কাছে। তবে স্বপ্ন দেখা থামাচ্ছেন না মারুফা। আগামী ডিসেম্বরে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

একদিন আগে মারুফার কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ছবিতে দেখা গেছে মারুফা তার বাবাকে কৃষি জমি তৈরিতে সাহায্য করেছেন। সাধারণত ট্রাক্টর কিংবা হাল দিয়ে জমি চাষাবাদের উপযোগী করা হয়। কিন্তু নিজেদের গরু কিংবা মহিষ নেই, ফলে কিছুই করার ছিল না মারুফার পরিবারের। এ অবস্থায় বাবার সঙ্গে ক্ষেতে নেমে পড়েন মারুফা। সব শক্তি দিয়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে মই টেনে জমি সমান করার কাজ করেন। ফেসবুকে এমন ছবি দেখে অনেকেরই মন খারাপ হয়, মারুফার জন্য মন কেঁদে ওঠে।

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলের ক্রিকেটার মারুফার হালচাষের এই ছবি ভাইরাল হয়েছে। শুধু ছবির দিনটি নয়, এমন প্রায় দিনই আসে মারুফার জীবনে। তবু নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে সংকোচবোধ হয় তার। জীবনযাপন করতে কতটা সংগ্রাম করতে হচ্ছে? বাংলা ট্রিবিউনের এমন প্রশ্ন শুনে থেমে থাকেন মারুফা, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থায় নেই। কোনোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে বাবাকে সাহায্য করি। আমাদের গরু-মহিষ নেই। ফলে বাবার জন্য একা কাজ করা কঠিন। তাই আমি তাকে সাহায্য করেছি মাত্র। এটা তেমন কিছু না।’

এভাবে করে কি ক্রিকেটের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব? আবার চুপ হয়ে যান মারুফা। গলাটা যেন ধরে এলো ১৫ বছর বয়সী পেসারের, ‘বাবার আয়ে কোনও রকমে জীবন চলছে আমাদের। নানার কিছু জমি ছাড়াও অন্যের কিছু জমি চাষাবাদ করে আমাদের সংসার চলে। খাওয়া-দাওয়া করে কোনও রকম থাকলেও বড় স্বপ্ন দেখা আমাদের জন্য নিষিদ্ধই বলা চলে। আমি ক্রিকেট নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি, মাঝে মাঝে মনে হয় সেটা আমার জন্য নয়। বড় বোনের বিয়ে হলেও বাকি তিন ভাই-বোন নিয়ে আমাদের বড় সংসার। বাবা সংসারের খরচ সামলাতেই হিমশিম খান। আমার স্বপ্ন পূরণ করা তার জন্য অনেক কঠিন।’

অভাব যার সংসারের নিত্যসঙ্গী, সেই মারুফা কী করে অনুশীলনের জন্য ভালো কোনও জায়গার বন্দোবস্ত করবেন! সেই আক্ষেপই বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠে, ‘আমার বাবা একাই আয় করেন। বাকি আমরা, ভাই-বোনরা খাওয়ার মানুষ। ইচ্ছা থাকার পরও টাকার কারণে আমি ভালো কোনও অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করতে পারি না। যদি অনুশীলনের সুযোগ পেতাম, নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারতাম।’

জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দেখে মারুফার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মারুফা চিন্তা করেন, জাহানারা-সালমাদের মতো অনুশীলনের সুযোগ পেলে নিজেকে মেলে ধরেতে পারতেন, ‘বড় আপুরা অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভালো করছে। আমি কিছুই পারছি না। এসব ভেবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। কিন্তু আসলে কিছুই করার নেই, বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। এলাকার বড় ভাইদের কাছ থেকে কোচিং করা ছাড়া, বাড়তি কিছুই আমি করতে পারিনি। মনে হয়, যদি ভালো কোনও জায়গায় অনুশীলন করার সুযোগ পাই, আমি আরও ভালো করতে পারবো। কিন্তু সেই সুযোগটা করে দেবে কে?’

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলের ক্রিকেটার মারুফার হালচাষের এই ছবি ভাইরাল হয়েছে। একদম ছোট্টবেলা থেকে খেলার প্রতি ঝোঁক মারুফার। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ফুটবল নিয়ে মেতে থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে ওঠেন মারুফা। তার কথায়, ‘আমার ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমি ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতাম। এরপর এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। তখন থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আমার ভালোবাসা শুরু হয়। সৈয়দপুরে আমাদের গ্রামে ইমরান ভাইয়ের স্থানীয় এক অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন শুরু করি।’

মারুফা বলে যেতে থাকেন তার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প, ‘ইমরান ভাই পরামর্শ দিয়েছিলেন বিকেএসপির জন্য ট্রায়াল দিতে। ২০১৮ সালে আমি ট্রায়াল দিয়ে বিকেএসপিতে সুযোগ পাই। ওখানে ২ মাস ক্যাম্প করার পর ভর্তি হতে গিয়ে পারিনি। আমার দুর্ভাগ্য আমি তখন ক্লাস নাইনে উঠে গেছি। বিকেএসপিতে অষ্টম শ্রেণি থেকে ভর্তি করায়। এ কারণে আর ভর্তি হতে পারিনি।’

ভর্তিতে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় মারুফা ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। এরপর খুলনার নারী ক্রিকেটার তৈরির কারিগর ইমতিয়াজ হোসেন পিলুর নজরে পড়েন মারুফা। তিনিই তাকে ২০১৯ সালে মোহামেডানের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলার সুযোগ করে দেন। সেই গল্পটা মারুফা শোনালেন এভাবে, ‘বিকেএসপিতে ভর্তি হতে না পেরে খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর পিলু স্যার আমাকে মোহামেডানে সুযোগ করে দেন। প্রিমিয়ার খেলার পর তো পিলু স্যার আমাকে খুলনার হয়ে খেলান। এরপর অনূর্ধ্ব-১৮ দলে সুযোগ পাই, ওখান থেকে এখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আছি।’

সাবেক ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথী আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন মারুফাকে এসএসসি পরীক্ষার্থী মারুফা এখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের ক্যাম্প শুরু হবে। পাশাপাশি বিকেএসপির দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্পে ট্রায়াল দিয়ে সেখানেও টিকে গেছেন এই পেসার। ২০ জানুয়ারি থেকে বিকেএসপির ক্যাম্পে অনুশীলন করার সুযোগ তার সামনে।

এই দুই ক্যাম্পের অনুশীলন দিয়েই ডিসেম্বরে বাংলাদেশে হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপে সুযোগ করে নিতে চান মারুফা। নিজের স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন তিনি, ‘শুনেছি ডিসেম্বরে বিশ্বকাপ। সামনের দুটি ক্যাম্পে আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই। আমার স্বপ্ন অনেক বড় ক্রিকেটার হবো। আমাকে সবাই চিনবে। জাহানারা-রুমানা-সালমা আপুদের মতো দলকে জেতাতে ভূমিকা রাখবো। বাংলাদেশ নারী দলের একজন হতে চাই। আমি আমার জীবনে আর কিচ্ছু চাই না।’

/কেআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া