স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এসে যদি দেখি আমাদের অর্জন কী—তাহলে নিঃসন্দেহে অনেক পরিসংখ্যান চলে আসবে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দৃঢ় অবস্থানই বারবার আলোচনায় আসবে। কিন্তু গণতন্ত্রের পথে চলার ঘাটতিগুলো কতটা দূর করতে পেরেছি, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে।
মত প্রকাশের যে অধিকার, তাই এখন সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে বলে মনে করছি। লিখতে গিয়ে, বলতে গিয়ে কত অভিজিৎ রায়কে মরতে হলো, কতজনকে দেশ ছাড়তে হলো! সরকারের বাইরেও যে মত প্রকাশের ওপর চাপ প্রয়োগ করার মতো শক্তি থাকে, এটা তার প্রমাণ। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল বা মহল, যারাই মানুষের নিজের কথা বলা এবং জানানোর অধিকারকে অস্বীকার করে, তারা চরিত্রে অত্যন্ত হিংস্র হয়ে থাকে। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার প্রচণ্ড ক্ষমতা আছে তাদের।
অবশ্য অনেকেই বলবেন, মত প্রকাশের একটা সীমা থাকতে হয়। যা খুশি বলার অধিকার দেওয়া হয়নি কোথাও। কোনও কথা বা বক্তব্য, যদি বড় আকারের সহিংসতা, রক্তপাত বা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে এবং তার ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তবে হয়তো তার প্রচার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা দরকার। তবে বাংলাদেশে বেশি উদ্বেগ ধর্ম নিয়ে লেখালেখিতে। যারা এই বিষয়ে লেখালেখি করেন, তাদের প্রতি প্রায় সবার উপদেশ থাকে, তারা যেন কারও অনভূতিতে আঘাত না করেন। যারা এমন নসিহত করছেন, তারা তাদের নিজস্ব ধর্মের বাইরে অন্য ধর্ম নিয়ে বিরামহীন কটাক্ষ করে যাচ্ছেন বা কটাক্ষ দেখে চুপ করে থাকেন। তখন এই অনুভূতির প্রশ্ন ওঠে না।
মত প্রকাশের যে অধিকার, তাই এখন সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে বলে মনে করছি। লিখতে গিয়ে, বলতে গিয়ে কত অভিজিৎ রায়কে মরতে হলো, কতজনকে দেশ ছাড়তে হলো! সরকারের বাইরেও যে মত প্রকাশের ওপর চাপ প্রয়োগ করার মতো শক্তি থাকে, এটা তার প্রমাণ। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল বা মহল, যারাই মানুষের নিজের কথা বলা এবং জানানোর অধিকারকে অস্বীকার করে, তারা চরিত্রে অত্যন্ত হিংস্র হয়ে থাকে। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার প্রচণ্ড ক্ষমতা আছে তাদের।
অবশ্য অনেকেই বলবেন, মত প্রকাশের একটা সীমা থাকতে হয়। যা খুশি বলার অধিকার দেওয়া হয়নি কোথাও। কোনও কথা বা বক্তব্য, যদি বড় আকারের সহিংসতা, রক্তপাত বা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে এবং তার ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তবে হয়তো তার প্রচার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা দরকার। তবে বাংলাদেশে বেশি উদ্বেগ ধর্ম নিয়ে লেখালেখিতে। যারা এই বিষয়ে লেখালেখি করেন, তাদের প্রতি প্রায় সবার উপদেশ থাকে, তারা যেন কারও অনভূতিতে আঘাত না করেন। যারা এমন নসিহত করছেন, তারা তাদের নিজস্ব ধর্মের বাইরে অন্য ধর্ম নিয়ে বিরামহীন কটাক্ষ করে যাচ্ছেন বা কটাক্ষ দেখে চুপ করে থাকেন। তখন এই অনুভূতির প্রশ্ন ওঠে না।
যারা ধর্মীয় রাষ্ট্র করতে চায় বাংলদেশকে, তারা কিংবা সরকারে থাকা ব্যক্তিবর্গ, তারা খুব কমই মানতে চান যে, কেউ যেকোনও মত প্রকাশ করতে পারেন স্বাধীনভাবে যদি না তিনি তা করতে গিয়ে সহিংতার পথ বেছে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের অধিকার স্বীকৃত। আছে তথ্য অধিকারের মতো আইনও। এরপরও মত প্রকাশের পথে প্রতিবন্ধক অনেক আইন আছে কিংবা নতুন নতুন আইন প্রণীত হচ্ছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা রয়েছে সেটির অপব্যবহার দেখছি প্রতিনিয়ত। এই আইন ব্যবহার করে যখন-তখন যাকে তাকে ইচ্ছামতো বিপদে ফেলার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। এইরকম ধারা মত প্রকাশের অধিকারকে খর্ব করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়েছে বলা যায়।
ব্লগার, লেখকদের যারা হত্যা করছে তার পেছনে আছে বৃহত্তর রাজনৈতিক তৎপরতা, যে রাজনীতি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। এই চক্রটা খুবই শক্তিশালী ও সক্রিয়। মত প্রকাশের পথে এরাই বড় বাধা। এদের হাতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব গেলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? দেশকে বাঁচিয়ে রাখাই কষ্টকর হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে যে কেউ যখন-তখন হরানির শিকার হতে পারেন।
ধর্মীয় অনুভূতির নামে যারা গলা টিপে ধরে বা হত্য করে যেকোনও কিছুতেই এই ভাবাবেগ ব্যবহার করতে পারে। আর ক্ষমতাসীনরা পারে রাষ্ট্রদ্রোহের ব্যাখ্যা খুঁজতে। বিরুদ্ধমত ও সমালোচনা দমনের অনেক ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে আছে। আমাদের ৪৫ বছরের স্বাধীনভাবে পথ চলার এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনে নানা ধারা ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
তবে বড় সমস্যা হলো ক্ষোভ প্রকাশের সংস্কৃতি। আমরা ক্রমেই একটা ক্ষুব্ধ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। যেকোনও ছুঁতোয় ক্ষোভের সহিংস প্রকাশ এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশের পুরো প্রক্রিয়াটির ভয়ঙ্কর সহিংস প্রকাশ আমরা দেখে চলেছি। আর এদের ভয়ে রাষ্ট্র ভীত কিংবা এদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এদের দাপটে বই নিষিদ্ধ হয়, বই মেলা থেকে বই প্রত্যাহার হয়ে যায়, সেই প্রকাশক জেল খাটেন। এদের দাবির মুখে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিনসহ অনেক লেখককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। লেখার জবাব লেখার মাধ্যমে না দিয়ে হুমকি আর পেশিশক্তির জোরে সবকিছু করে এই গোষ্ঠী। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে এই সমস্যাকে গণতন্ত্রের পথে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়। আর আছে রাজনীতির দাপট। আইনের বাইরে শুধু রাজনীতির পরিচয়ের কারণে অনেকের দাপট চোখে পড়ার মতো। রাজনীতির ভেতরে এমনসব চরিত্র আছে, যারা অতিমানবে পরিণত হয়েছেন এবং তারা সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে।
ইতিহাস কিংবা ব্যক্তি কোনও বিষয়েই নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষভাবে কোনও কিছু প্রকাশ করা যায় না এখন। সমাজে বহু ধর্মের মানুষ থাকে। দেশের ইতিহাসে নানা রাজনীতি নানা সময় প্রভাব ফেলেছে। মানুষের অনুভূতির বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার সবারই। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কিংবা ইতিহাসের কোনও বিষয়ে বা চরিত্র সম্পর্কে যদি খোলামেলা আলোচনা করা না যায়, তাহলে কোন পথে হাঁটছি আমরা? আমরা কেবলই স্পর্শকাতর, অসহিষ্ণু ও রসবোধহীন হয়ে উঠছি?
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি