X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

৫০ বছরের বাংলাদেশ: শত্রু-মিত্রের হিসাবেই আটকে আছি আমরা

লীনা পারভীন
২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:০০আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:০০
লীনা পারভীন আমার এই লেখাটা কিছুটা নেতিবাচক হলেও হতে পারে। এ বছর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পালন করলাম। সুবর্ণজয়ন্তীর এই উৎসব ছিল বছরব্যাপী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও।

নানা উৎসব, আয়োজনে গত একটি বছর ধরে আমরা নানা পরিকল্পনায় চেষ্টা করেছি এই দিবসকে স্মরণীয় করে পালন করতে। সেটা হয়েছেও। উৎসব আয়োজকদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে কিছু সমালোচনা বা আলোচনা থাকলেও এই মহামারিতে মোটামুটি সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

কিন্তু আমার আলোচনা ভিন্ন জায়গায়। গত ৫০ বছরের মাঝে বেশিরভাগ সময়ে ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। দেশবিরোধী নানা শত্রু-মিত্রের কর্মকাণ্ডকে মাথায় রেখেও আমি প্রশ্নটি করতেই চাই, আমাদের এই বাংলাদেশের যতটা আগানোর কথা ছিল সেই জায়গায় প্রতিটা ক্ষেত্র ধরে ধরে কোথায় কতটা এগোলাম আর কতটা পিছালাম সেই হিসাবটাও করেছি কি আমরা?

এগোনোর গল্পটা আমরা সবাই জানি। আছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। এই এগোনোর গল্পের নায়কের নামও আমাদের জানা আর তিনি হচ্ছেন আমাদের সবার নেতা, এই স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর একমাত্র উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই একজন ব্যক্তির পরিকল্পনাতেই মূলত গ্রন্থিত হয়েছে সব সফলতার গল্পগুলো।

কিন্তু মূল একটি জায়গায় আমাদের আসলে ফিরতেই হবে, আর সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ, স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের বাংলাদেশ গড়ার কাজটি আমরা কতটা করতে পেরেছি? যে ৩০ লাখ মানুষ তাদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিল অকপটে, যে ২ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল, তাদের সেই আত্মত্যাগ কতটা ফিরিয়ে দিতে পেরেছি আমরা?

প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কেন এই জায়গাটি নিয়ে কথা বলতে চাইছি? মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । আছে এমন আরও কিছু অর্জন। কিন্তু  সব প্রাপ্তির হিসাবটা শূন্য হয়ে যায় যখন দেখি এখনও স্বীকৃতির লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। তালিকায় নাম না থাকায় ভাতা পায় না রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। অথচ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাবদ্ধ করে বছরের পর বছর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা খেয়ে যাচ্ছে কিছু নকল মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে ভাতা নিচ্ছে চিহ্নিত রাজাকার।

মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতির জন্য লড়াই করেনি, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি তাদের যোগ্য সম্মান নিশ্চিত করাটাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাহলে এই এত বছরেও আমরা ন্যূনতম একটা সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বানাতে পারলাম না। এই ব্যর্থতাও কি আমাদের ৫০ বছরের হিসাবে আসা উচিত না?

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও আমাদের চিন্তিত হতে হয় আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে তা নিয়ে। এখনও আমরা তারুণ্যকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আকৃষ্ট করতে পারছি না। আমাদের প্রজন্ম দারুণভাবে বিভ্রান্ত। কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, কেন পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কাছে ঘৃণ্য সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিয়ে যেতে হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনও সফলভাবে সারাদেশে প্রগতি বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যেতে পারছে।

অথচ, এগুলো তো একদম মৌলিক কাজ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কেন চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে? কেন মুক্তিযোদ্ধাকে ভিক্ষা করে খেতে হবে? এই প্রাপ্তির জন্যই কি তারা সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান এই বাংলার। তাদের খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়। এটি কোনও ব্যক্তির দায় হবার কথা ছিল না।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাত ধরেই আসতে হয় সামাজিক ও শিক্ষার উন্নয়নের বিষয়টি। আফসোসের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, আমাদের সামাজিক উন্নয়নের অনেক জায়গায় আমাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটলেও গুণগত উন্নয়নের জায়গাটি একদমই অর্জিত হয়নি। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার জায়গাটি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমবণ্টনের জায়গাটি এখনও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আয় সবার সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়নি,  যে কারণে উন্নয়নের ফসল সবার ঘরে সমানভাবে পৌঁছেনি। একদিকে আয় বেড়েছে আরেকদিকে ব্যয়ের যত খাত আছে সেগুলোও বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই জায়গায় কেন্দ্রীয় কোনও নিয়ন্ত্রণ খুব একটা কাজ করেনি। দেশপ্রেমিক “বাংলাদেশি” আজ যেন সংখ্যায় লঘু একটি গোষ্ঠী।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাই এখন আমরা হিসাব করি কোন দেশে কত কোটি টাকা পাচার হয়ে গেলো? এই যে পাচার হয়ে যাচ্ছে এর প্রতিটা পয়সা এই দেশ থেকে আয় করা। অথচ এর একভাগও বিনিয়োগ হচ্ছে না দেশে। কেন? কর্মসংস্থানের জায়গাটি নতুন করে কোনও আশা জাগাতে পারছে না। একমাত্র সরকারি চাকরিতেই এসেছে নতুনত্ব বা আকর্ষণ। বেতন, সুযোগ, সুবিধা, ক্ষমতা সবদিকের বিবেচনাতে এই মুহূর্তে এগিয়ে আছে সরকারি চাকরিজীবীরা। অথচ, এই কথা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না যে একটি দেশের সার্বিক ও স্থায়ী উন্নয়নের জন্য দরকার সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমানুপাতিক উন্নয়ন। একা রাষ্ট্রের পক্ষে সব জনগণের দায় নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু বেসরকারি খাতকেও তৈরি করতে হয়। পেরেছি কি আমরা?

সুবর্ণজয়ন্তীর আমেজকে আমি নষ্ট করে দিতে চাই না, কিন্তু ৫০ বছরের বাংলাদেশ নিয়ে যদি আলোচনা করতে হয় তাহলে এর পুরোটাই করতে হবে। এমন আরও অনেক দিক আছে যে জায়গাটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষা খাতের নেই কোনও আধুনিকতা অথচ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমরা এখনও মান্ধাতা আমলের ক্যারিকুলাম নিয়েই আছি। বিশ্ব এখন ব্রহ্মাণ্ড জয়ের পথে আর আমরা ব্যস্ত থাকি কে শত্রু আর কে মিত্র সেই হিসাব নির্ধারণে।

৫০ বছরের পথচলায় এখনও আমরা কে বাংলাদেশের শত্রু আর কে মিত্র সেই হিসাবের ফয়সালাটাই করে উঠতে পারলাম না। এই একটা ব্যর্থতা আমাদের প্রতিটা অগ্রগতিকে টেনে ধরে বারবার। এতদিনে অন্তত এই চিহ্নিত করার জায়গাটা যদি পরিষ্কার করতে পারতাম, তাহলে আগানোর গল্পটা থাকতো অন্যরকম আর আমার এই লেখাটাও হয়ে পড়তো অপ্রয়োজনীয়।
 
লেখক: কলামিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এলো বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এলো বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ