X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুখের দিনে কিছু অসুখের কথা

রেজানুর রহমান
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৪৯আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৪৯

জিতলেই নায়ক। আর হারলেই খলনায়ক। অথচ যে কোনও খেলায় জয়-পরাজয় দুটোই থাকে। জয় যেখানে আছে পরাজয়ও সেখানে থাকে। কেউ জয় পায়, কেউ হারে। এটাই খেলার নিয়ম। অথচ আমরা জয়ীদের জন্য সংবর্ধনার যে ডালা সাজাই। কিন্তু তার ছিটে ফোটাও করি না পরাজিতদের জন্য। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন পরাজিতদের জন্য কি আমি সংবর্ধনা চাচ্ছি? মোটেই তা নয়। পরাজিতদের জন্য সংবর্ধনা চাওয়ার কোনও যুক্তি নেই। তারা সংবর্ধনা নেবেও না। তবে তারা একটু সহমর্মিতা পাবার আশা করতেই পারে। হেরেছি বলেই দারুণ একটা অন্যায় করেছি তাতো নয়। পরাজয় যেখানে জয়ও সেখানে। আজ পারিনি তাই বলে কাল পারবো না এমন তো কথা নেই।

মেয়েদের ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই এখন সেরা। সাবিনা ও কৃষ্ণারা প্রমাণ করলো, হ্যাঁ বাংলাদেশও পারে। দেশের প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সারা দেশের মানুষের মুখে-মুখে এখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ব্যাপক প্রশংসা। দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম পড়ে আনন্দে মনটা ভরে গেলো। মেয়েদের জয়, দেশের জয়, এভারেস্টের চূড়ায় দেশের মেয়েরা, শিরোপার চেয়েও বেশি কিছু, শাবাশ মেয়েদের দল, হিমালয়ের দেশে অদম্য মেয়েরা, সাফ ফুটবলে মেয়েদের নতুন ইতিহাস– বিভিন্ন পত্রিকার এই শিরোনামগুলো দেখে অনেক আশা জাগল মনে। এখন বাংলাদেশ নারী দলের সুখের দিন। আশা করি গর্জিয়াস সংবর্ধনা হবে। লড়াকু মেয়েরা যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মেয়েদের এই জয়ে আমরা কি সবাই আনন্দিত?

মেয়েরাও ফুটবল খেলুক, হাডুডু খেলুক– সমাজ কি এজন্য তৈরি? আজ মেয়েদের জয়ের দিনে ঈর্ষাকাতর মানুষগুলো হয়তো চুপ করে আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত তালি দিচ্ছেন। এতে কি মেয়েদের ফুটবল আদৌ এগুবে?

জাতীয় ফুটবল দলের যে মেয়েরা সাফ শিরোপা জিতে নিয়ে এলো তাদের সবার খেলোয়াড়ি জীবন কম-বেশি কষ্টের ও আতংকের। গ্রাম থেকে উঠে আসা কয়েকজনের বিরুদ্ধে এলাকার সমাজপতিদের ধ্যান ধারণা উদ্বেগজনক। মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে? এই অভিযোগে দেশের অনেক জায়গায় মেয়ে খেলোয়াড়দের দরিদ্র পরিবারকে এক ঘরে করে রাখার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করা হয়েছে। আজ মেয়েরা জয় পেয়েছে বলে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু একটা বিপরীত চিত্র কল্পনা করুন তো। কোনও কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা যদি সাফ ফুটবলের ফাইনালে হেরে যেত তখন কি সাবরিনা ও কৃষ্ণাদের নিয়ে আমরা কোনও আগ্রহ দেখাতাম। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৫১ পেলেই জয়ী দলের খাতায় নাম লেখানো সম্ভব। অথচ ৪৯ যে দল পেয়েছে তার অবদানও কিন্তু কম নয়। মাত্র দুই নম্বরের ব্যবধান। কিন্তু এজন্য কত অবজ্ঞা আর অনীহাই না সহ্য করতে হয়।

সাফ নারী ফুটবল দলের কথাই যদি ধরি। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এবার নিশ্চয়ই মেয়েরা সংবর্ধনা পাবে। তাদের জন্য নানা ধরনের উপহারের আয়োজন করা হবে। প্রশ্ন হলো যদি নেপালের কাছে হেরে যেত বাংলাদেশ। তাহলে কি এত প্রশংসা জুটতো? সোজা কথা যে হারে তার জন্য আবার কীসের প্রশংসা? তার মুখ দেখাও তো পাপ! এই মানসিকতার বিরুদ্ধেই আমার আজকের এই লেখা।

প্রসঙ্গক্রমে চ্যাম্পিয়ন এই দলের কোচ গোলাম রব্বানীর কথা একটু বলি। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর নারী ফুটবল দলের সঙ্গেই আছেন তিনি। কত যে কটু কথা শুনতে হয়েছে। ‘ওই যে মহিলা কোচ যায়’ এমন টিপ্পনী শুনেছেন বহুবার। বলতে গেলে মেয়েদের ফুটবলে শুরু থেকেই আছেন। শুরুর দিকে সবাই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। রব্বানী নিজেই বহুবার এই কষ্টের কথা বলেছেন, যখন আমি কোচিং শুরু করি তখন আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেককেই বলতে শুনেছি– ওই যে মহিলা কোচ যাচ্ছে। রাস্তায় যখন হেঁটে যেতাম আমাকে দেখে অনেকেই হাসাহাসি করতো, ঠাট্টাও করতো... সেই গোলাম রব্বানীর এখন অনেক প্রশংসা হচ্ছে। একবার ভাবুন তো কোনও কারণে এই ফুটবল দলের অবস্থা যদি নেপালের মতো হতো?

ফাইনালে নেপাল-৩, বাংলাদেশ-১ তাহলে গোলাম রব্বানীর অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? নেপালের ঐতিহাসিক দশরথ স্টেডিয়ামে নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। একে তো বৃষ্টি ভেজা কর্দমাক্ত মাঠ, তার ওপর গ্যালারি ভরপুর নেপালি দর্শক। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেরও নেপালের মতো অবস্থা সৃষ্টি হতে পারতো। তখন বাংলাদেশের লড়াকু মেয়েদের জন্য আমরা কি এতো ভালো ভালো কথা বলতাম? আবারও বলি জয় পেলেই সাধারণত প্রশংসা জোটে। কিন্তু পরাজিত হলে প্রশংসা না পাই সহমর্মিতা তো পেতে পারি? ফুলের শুভেচ্ছা দিতে না পারি, হৃদয়ের উষ্ণতা তো দিতে পারি। বলতে তো পারি– চিন্তা করো না। এবার হয়নি। নিশ্চয়ই আগামীতে হবে। এগিয়ে যাও...

আমরা কতজন এই মানসিকতা ধারণ করি? খেলাধুলায় ছেলের পক্ষে অর্থাৎ পুত্র সন্তানের পক্ষে দাঁড়াই। পুত্র সন্তান যা করতে চায় তাতেই সায় দেই, সম্মতি জানাই। আর মেয়ে সন্তানের বেলায় এখনও অনেক কাজে ‘না’ শব্দটাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। একথা সত্য, বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করায় দেশের অনেক মানুষ খুশি হয়েছেন। কিন্তু পরিবারের মেয়ে সন্তানকে ফুটবলে দিতে চাইবেন কতজন? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বেড়ে ওঠা নারী ফুটবলারদের উদাহরণ দিতে চাই। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এবার সাফ নারী ফুটবল দলে বাংলাদেশের হয়ে যারা খেলতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে কালসিন্ধুর এলাকারই ৮ জন আছেন। মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি, তহুরা, শামসুন্নাহার, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তারের বাড়ি কলসিন্দুরে।  

গোল করা স্বপ্নার বাড়ি রংপুরে। আঁখি সিরাজগঞ্জের, সাবিনা ও মাসুদা সাতক্ষীরার, কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের। মনিকা, রুপনা ও ঋতুপর্ণা রাঙ্গামাটির বাসিন্দা। চরম প্রতিকূল পরিবেশে তারা নিজ নিজ অবস্থানে লড়াই করে মহিলা ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছে। সাফ ফুটবলে সাফল্যের পর সবার উচিত শুধু ফুটবল নয়, ক্রীড়ার অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুরুষের মতো নারীর অংশগ্রহণের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা।

নারী ফুটবল দলের লড়াকু সৈনিক সানজিদার একটি স্ট্যাটাস উল্লেখ করার মাধ্যমে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। নেপালে ফাইনাল ম্যাচের আগে সানজিদা ফেসবুকে লিখেছিলেন– যারা আমাদের স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্ন সারথিদের জন্য আমরা সাফ এর শিরোপা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে। সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করছে, তাদের জন্য শিরোপা জিততে চাই।

সানজিদারা শিরোপা জিতেছে। অনেক আনন্দ-উৎসব হবে। সানজিদার লেখায় ‘সমাজের টিপ্পনী’ বলে একটি বাক্য আছে। এই বাক্যটিতেই অভিমান স্পষ্ট। আর এই টিপ্পনী হলো অসুখ। আমরা যেন এই অসুখ সারানোর আন্তরিক চেষ্টা করি। তা না হলে মেয়েদের ফুটবল আদৌ আর কতদূর যাবে বলা মুশকিল।

পাঠক, সুখের দিনে অসুখের কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে কথাগুলো ভাববেন আশা করি। নারী ফুটবল দলের সকল সদস্যের জন্য রইলো প্রাণঢালা অভিনন্দন। এগিয়ে যাও বোনেরা। অনেকে শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ