হেবা দলিলের রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ যেখানে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা, সেখানে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার এক বাসিন্দাকে গুণতে হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা! বাঁশখালী উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের এমন দুর্নীতির তথ্য ওঠে আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বাঁশখালী উপজেলা চত্বরে এ গণশুনানির আয়োজন করে দুদক।
উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল মোমেন চৌধুরী গত ডিসেম্বর মাসে তার বোনকে ৪৫ শতাংশ জমি হেবা করেন। ওই সময় তাকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ওই জায়গা হেবা দলিল করতে হয়। গণশুনানিতে আবুল মোমেন চৌধুরীর চাচাতো ভাই রাশেদ আলী এ অভিযোগ করেন। তিনি জানান, হেবা করতে আবুল মোমেন উপজেলা ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জমিটি রেজিস্ট্রি করতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানানো হয়। সে অনুযায়ী, ওই জমি রেজিস্ট্রি করতে তিনি প্রথমে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা দেন। ভূমি অফিসের মুন্সি হারুন-অর-রশিদ সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর (ইনিশিয়াল) দিয়ে টাকাগুলো গ্রহণ করেন। পরে আরও ত্রিশ হাজার টাকা হাতে হাতে দেওয়ার পর গত ১০ ডিসেম্বর জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। এসময় রাশেদ আলী স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের রশিদও উপস্থাপন করেন।
শুধু এই অভিযোগ নয়, শুনানিতে আরও অভিযোগ ওঠেছে দলিল রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, রেকর্ড সংশোধনসহ অন্যান্য সেবা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির শিকার হচ্ছেন উপজেলার বাসিন্দারা। ঘুষ ছাড়া ওইসব অফিসে কোনও কাজ হয় না এমন অভিযোগও করেন অনেকে।
দুদক বাঁশখালী উপজেলা কমিটির সভাপতি তাপস কুমার নন্দী অভিযোগ করেন, সম্প্রতি দুদকের একটি টিম সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ঘুরে যাওয়ার পর ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষের ‘রেট’ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আগে ঘুষ নেওয়া হতো ১১ শতাংশ। কিন্তু কয়েকদিন ধরে মুন্সি-ভেন্ডররা ২০ শতাংশ হারে ঘুষ নিচ্ছেন। তাপস নন্দী আরও অভিযোগ করেন, সাব-রেজিস্ট্রার সপ্তাহে মাত্র দু’দিন অফিস করেন। ওনাকে অফিসে গিয়ে লোকজন পায় না। সৌদি প্রবাসী হাজী আবুল হোসেন অভিযোগ করেন, তিনি বাঁশখালী পৌরসভায় একটি দোকান বিক্রি করতে চাইলে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মচারীরা তার কাছে ঘুষ দাবি করেন।
এসময় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান তার কাছে কারা ঘুষ দাবি করেছে সুনির্দিষ্ট করে বলতে বললে আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি নাম বললে আমাকে বাঁশখালীতে থাকতে দেবে না। তাদের অনেক শক্তি। মামলা-হামলা করে আমাকে বসত ছাড়া করবে। আমরা নিরীহ মানুষ, তাই তাদের সব দাবি-দাওয়া মেনেই আমাদের কাজ করতে হয়।’ নবী হোসেন নামে উপজেলার আরেক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, তিনি নামজারি করতে গেলে সার্ভেয়ার মহিউদ্দিন তার কাছে ঘুষ দাবি করেন। না দিতে চাইলে তাকে ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেন।
তাজ উদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, একই জমি দুই জনের নামে খতিয়ান হয়। বিষয়টি সংশোধন করতে আবেদন করলে সার্ভেয়ার মহিউদ্দিনকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৪ বছর ধরে তিনি বার বার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ধর্ণা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত পাননি। শুনানিতে সার্ভেয়ার মহিউদ্দিনের নামে আরও একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেন। মহিউদ্দিন প্রকাশ্যে ঘুষ নেন বলেও তারা দাবি করেন। ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসকে ঘিরে একটি শক্তিশালী দালাল চক্রের মাধ্যমে ঘুষ আদান-প্রদান হয় বলে তারা অভিযোগ করেন।
পরে তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান সার্ভেয়ার মহিউদ্দিনের কাছে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সন্তোষজনক কোনও উত্তর দিতে পারেননি। এসময় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দুর্নীতি তো মাউন্ট অব দ্য এভারেস্ট-এ পরিণত হয়েছে।’ এসময় মহিউদ্দিন মিস কেসের কথা বললে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘নিজে সৎ থাকলে, সবার কথা শুনলে, নিয়মিত শুনানি করলে মিস কেস হওয়ার কথা নয়।’
শুনানিতে প্রধান অতিথি ছিলেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, জনপ্রতিনিধিরাও দুদক আইনের আওতায় আছেন। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এসময় তিনি সার্ভেয়ার মহিউদ্দিনকে বরখাস্ত করার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেন। দুদক কমিশনার বলেন, ‘মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, তাকে সাসপেন্ড করা উচিত।’
অনুষ্ঠানে বাঁশখালী আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী চাহেল তস্তুরীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পদস্থ কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা উপস্থিত ছিলেন।