X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

কী ছিল বাঁশখালীর প্রশ্নপত্রে

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২৫ আগস্ট ২০১৭, ০৩:১৩আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৭, ১৬:৩২

লিয়াকত আলী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাঁশখালীর এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে তুলনা করে প্রণীত প্রশ্নপত্রে কারও নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও প্রশ্নের বিবরণে দু’জনের পরিচিতি সুস্পষ্ট বলে জানিয়েছেন ওই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ধর। বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘যদিও প্রশ্নপত্রে কারও নাম সরাসরি উল্লেখ নেই, তবুও গণ্ডামারা গ্রাম ও চেয়ারম্যান উল্লেখ করায় এখানে গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলীর বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অন্যদিকে, পরের অংশে বাংলাদেশ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের বিষয়টি উল্লেখ থাকায় স্বাভাবিকভাবে প্রতীয়মান হয় এখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বোঝানো হয়েছে।’

নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের ৪ নম্বর প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গণ্ডামারা গ্রাম আজ লণ্ডভণ্ড অবস্থা। যেদিকে তাকাই শুধু ধ্বংসযজ্ঞ। চেয়ারম্যান জনাব ‘এল’ এ অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত হন। তিনি এ অবস্থা দেখে তার গ্রামবাসীকে রক্ষা করেন। অল্পসময়ের মধ্যে গ্রামবাসী ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে এবং সফলকাম হয়। সকলে এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, জনাব ‘এল’ এর জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। (গ) উদ্দীপকে উল্লিখিত নেতা জনাব ‘এল’ এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোন নেতার মিল রয়েছে? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে উক্ত নেতার গৃহীত পদক্ষেপগুলো পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ব্যাখ্যা কর। (ঘ) প্রশ্নে যুদ্ধবিধ্বস্ত যে কোনও দেশের উন্নয়নে এরূপ নেতার প্রয়োজন উক্তিটির আলোকে উক্ত নেতার অবদান মূল্যায়ন কর।’  

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ধর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশ্নটি প্রণয়নের জন্য বাঁশখালী উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. তাহেরুল ইসলাম ও দুকুল বড়ুয়া সরাসরি জড়িত। দক্ষিণ জেলা শিক্ষক সমিতি প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য বাঁশখালী উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. তাহেরুল ইসলামকে দায়িত্ব দিলে তিনিই এই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য দুকুল বড়ুয়াকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অন্য আসামিরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও দায়িত্বে অবহেলার কারণে তারা এই মামলায় আসামি হয়েছেন।’

বিকাশ রঞ্জন ধর বলেন, ‘অন্য আসামিরা দক্ষিণ জেলা শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। তাদের অনুমতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হয়েছে। তাদের অনেকে প্রশ্নটি প্রস্তুত করার পর সেটি মনিটরিং ও মূল্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন। তারা এই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করা যায় এমন সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই এটি প্রিন্ট করা হয়েছে। আবার তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলার স্কুলগুলোয় প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। তাই তারাও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কাজটি করেছেন। ভুল করে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে কাজটি করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাঁশখালীর বাইরে অন্য উপজেলার এই শিক্ষকরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। এ কারণে এত বড় একটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষ হোক তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। এ কারণেই তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। পুলিশের তদন্তে তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি ওঠে এসেছে।’ প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই মামলার সর্বোচ্চ সাজা হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাজা হলো ১৪ বছর জেলসহ জরিমানা।’

অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী নুরুল আবছার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদিও প্রশ্নপত্রে বঙ্গবন্ধু ও চেয়ারম্যান লিয়াকতের নাম সরাসরি উল্লেখ নেই, তবুও প্রশ্নটি পড়ে দু’জনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এজন্য প্রশ্ন কর্তাকে দায়ী করা যায়, কারণ তিনিই প্রশ্নটি করেছেন। অন্যদের এজন্য সরাসরি দায়ী করা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্যদের দায়িত্বে অবহেলা আছে। তবে তারা যেহেতু সরাসরি জড়িত নন, পুলিশ চাইলে তাদের চার্জশিট থেকে বাদ দিতে পারতো। আদালত চাইলে তাদের জামিন মঞ্জুর করতে পারতেন। কারণ, এর আগে তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন।’

বাঁশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাথমিক অভিযোগ পাওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই আমরা দুকুল বড়ুয়া ও তাহেরুল ইসলামকে গ্রেফতার করি। পরে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক তৎকালীন এডিসিকে (শিক্ষা) প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি প্রধান করেন। ওই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এই ১৩ শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তুলে ধরে। এ ঘটনায় আমরা নিয়ম মেনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য আবেদন করি। মন্ত্রণালয়ের আবেদন পাওয়ার পর আমরা আদালতে প্রসিকিউশনের আবেদন করি। আদালতের নির্দেশে পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তদন্ত শেষে গত ১২ এপ্রিল আমরা আদালতে চার্জশিট দেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তদন্তে এ ঘটনার সঙ্গে ১৩ জনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ওঠে আসে। দুকুল বড়ুয়া প্রশ্নটি প্রণয়ন করলেও সেটি মূল্যায়ন ও মনিটরিংয়ের সঙ্গে অন্যরা জড়িত ছিলেন। তাই দায়িত্বে অবহেলা হোক আর ইচ্ছকৃত হোক তারা সবাই সমান অপরাধী।’

২০১৬ সালের ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বিষয়ের সৃজনশীল প্রশ্নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাঁশখালী গণ্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান লিয়াকত আলীকে তুলনা করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। পরে ওই প্রশ্নপত্রে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৬টি উপজেলার ৯৭টি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরে বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হলে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী বাঁশখালী বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দুকুল বড়ুয়াকে পুলিশে সোপর্দ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকসহ প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ।

মামলা দায়েরের পর ১৩ শিক্ষক হাইকোর্ট থেকে তিন মাসের আগাম জামিন নেন। গত বুধবার (২৩ আগস্ট) আগাম জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা ফের জামিন আবেদন করতে গেলে আদালত তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আসামিরা হলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী দুকুল বড়ুয়া, বাঁশখালী উপজেলার নাসেরা খাতুন আরকে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু তাহের, একই উপজেলার রায়ছটা প্রেমাসিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মোহাম্মদ মিয়া, আনোয়ারা উপজেলার পাঠানিকোঠা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক, আনোয়ারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাদল চন্দ্র দাশ, পটিয়া উপজেলার মোজাফ্ফরাবাদ এমজে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইউসুফ, একই উপজেলার হাইদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক শ্যামল কান্তি দে, সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজিত চারণ, একই উপজেলার চন্দন পাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এম ওয়ায়েদ উদ্দিন, বোয়ালখালী উপজেলার মনসুর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী, একই উপজেলার কদুরখিল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমির হোসেন, চন্দনাইশ উপজেলার কেশুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজন ভট্টাচার্য ও একই উপজেলার বড়মা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হোসেন।

মামলা দায়েরের সময় এই শিক্ষকরা বাঁশখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৬টি উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

 

 

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা