X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

৬৬ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি ভাষা আন্দোলনের কবি শামসুদ্দিনের

এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৫৫আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১১:৩৫

চারণকবি শামসুদ্দিন আহমেদ (ছবি- প্রতিনিধি)

‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’ গানের লাইনগুলো চারণকবি শামসুদ্দিন আহমেদের লেখা। বাগেরহাটের এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম তার। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন সারাদেশ উত্তাল, মায়ের ভাষার স্বীকৃতি পেতে বাংলার দামাল ছেলেরা যখন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, ভাষার জন্য রাজপথে অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন, তখন সেই অজোপাড়াগাঁর শামসুদ্দিনও লেখনি নিয়ে আন্দোলনে শরিক হন। লিখেন বাহান্নের ইতিহাস পড়ে ফেলার উপযোগী ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামের ওই গান, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের। কিন্তু বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পরও রাষ্ট্রীয় কোনও স্বীকৃতি পাননি শামসুদ্দিন আহমেদ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি লেখেন শামসুদ্দিন আহমেদ। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন শেষে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠে সমাবেশ করা হয়। সেখানে নিজের লেখা বিদ্রোহের গান ‘রাষ্ট্রভাষা’ গেয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন শামসুদ্দিন আহমেদ। পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে তিনি এ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন। গানটি অল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের পর ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি দেশের অনেক গুণি শিল্পীর কণ্ঠে পরিবেশিত হয়েছে।

১৯১৫ সালে বর্তমান বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চারণকবি শামসুদ্দিন। তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে, যার বর্তমান নাম বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লোখাপড়া করেন। তবে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি।

শামসুদ্দিন আহমেদের একতারা (ছবি- প্রতিনিধি)

ছেলেবেলা থেকেই কবিতা ও গান লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল শামসুদ্দিনের। পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ভক্ত ছিলেন তিনি। শামসুদ্দিন তেল বিক্রেতা ছিলেন বলে লোকশ্রুতি আছে।

শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। অভাবের সংসারে শামসুদ্দিনের ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখা করতে পারেনি। শামসুদ্দিনের বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘আমার বাবা গরিব মানুষ ছিলেন। তিনি হাটবাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। একইসঙ্গে গান লিখতেন। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তিনি গান লিখেন। গানগুলো জনপ্রিয়ও ছিল। তবু তিনি রাষ্ট্রীয় কোনও স্বীকৃতি পাননি।’

শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন আরও জানান, ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি শামসুদ্দিন প্রথমে লোকসুরে গেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা হলেও গানটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে মুক্তিকামী মানুষদের।

শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন জানান, ১৯৭৪ সালে তার বাবা শামসুদ্দিনের জীবনাবসান হয়। বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কের পাশে নিজ গ্রাম ফতেপুরে শামসুদ্দিনকে সমাহিত করা হয়। স্মৃতি হিসেবে এখনও তার একটি একতারা রয়েছে।

শামসুদ্দিন আহমেদের কবর (ছবি- প্রতিনিধি)

শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন জানান, ড. শেখ গাউস মিয়ার ‘মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাগেরহাট’ নামে লেখা বইয়ে তার বাবার ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা গানটি রয়েছে। তিনি চারণকবি শামসুদ্দিনকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানান।

বাগেরহাট শামসুদ্দিন-নাহার ট্রাস্ট্রের (স্থানীয় শিক্ষক সামছুদ্দিন ও তার স্ত্রীর নামে করা একটি অলাভজনক সংস্থা) প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জি বলেন, ‘শামসুদ্দিন বড় মাপের কবি ছিলেন। তার দু’টি গানের বই ছাপা হয়েছিল, যার একটি এখন পাওয়া যায়। বইটির প্রশংসাপত্র লেখেন পল্লীকবি জসিম উদ্দিন। এই গানের সংকলনের ফটোকপি আমার কাছে আছে। আর অন্য সংকলনটি এখন আর পাওয়া যায় না।’

বাগেরহাটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, ‘চারণকবি শামসুদ্দিন পেশায় তেলবিক্রেতা ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ছিল অনেক প্রতিভা। তার যুগান্তকারী সেই গানের কলি- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি, এখনও আমার কানে ভসে আসে। ভাষা আন্দোলনের পরে আওয়ামী লীগের সব অনুষ্ঠানে চারণকবি শামসুদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হতো গান পরিবেশনের জন্য। তবে পরবর্তী সময়ে অভাব-অনটনে ভুগে তার মৃত্যু হয়।’

বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, ‘কবি শামসুদ্দিনকে নিয়ে বাগেরহাটবাসী গর্বিত। বর্তমান সরকার ভাষা সৈনিকদের সম্মানিত করছে, তাদের স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, চারণকবি শামসুদ্দিনকেও স্বীকৃতি দেওয়া হবে।’

 

/এমএ/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
‘তীব্র গরমে’ মারা যাচ্ছে মুরগি, অর্ধেকে নেমেছে ডিম উৎপাদন
‘তীব্র গরমে’ মারা যাচ্ছে মুরগি, অর্ধেকে নেমেছে ডিম উৎপাদন
ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক
ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক
রোমাকে হারিয়ে ফাইনালে এক পা লেভারকুসেনের
ইউরোপা লিগরোমাকে হারিয়ে ফাইনালে এক পা লেভারকুসেনের
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
শিগগিরই শুরু হচ্ছে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
শিগগিরই শুরু হচ্ছে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী