X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহহীনের ঘর সচ্ছলদের নামে!

জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা
১৪ আগস্ট ২০১৮, ২১:৪৮আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০১৮, ২২:০১

দরিদ্র ও ভূমিহীনদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন সচ্ছল পরিবারের লোকজন ও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের স্বজনরা। অভিযোগ আছে, উপজেলার বামনডাঙ্গাসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা ১৫-২০ হাজার টাকা করে নিয়ে সচ্ছল পরিবারের লোকজন ও নিজেদের স্বজনদের ঘরগুলো বরাদ্দ দিয়েছেন।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ‘যার জমি আছে, ঘর নেই’ তাদের জন্য ৩৫৭টি ঘর নির্মাণ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় তিন কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় একলাখ টাকা। উপজেলা কার্যালয় থেকে ইতোমধ্যে বরাদ্দের অর্থ তুলে গৃহ নির্মাণ সামগ্রী তৈরি শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ঘর বরাদ্দে প্রকল্পের নীতিমালা মানা হচ্ছে না। যাচাই-বাছাই ছাড়াই টাকার বিনিময়ে এসব ঘর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সচ্ছলদের।

স্থানীয় দরিদ্র ও ভূমিহীনদের অভিযোগ, ইউএনও’র আনুকূল্যে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা ঘর বরাদ্দে অনিয়মের সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া, যেসব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে।

বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে অনুসন্ধান চালিয়ে ঘর বরাদ্দে অনিয়ম ও অর্থ-বাণিজ্যের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ইউনিয়নে ২২ ব্যক্তির নামে ঘর বরাদ্দ হয়। কিন্তু ১৭ জনকে চিহ্নিত করা গেলেও বাকি পাঁচ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মেম্বরদের অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে ভূমিহীন পরিবারের পরিবর্তে জমি, ঘর-বাড়ি আছে –এমন মানুষদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিয়নে সুমন নামে একজনকে দিয়ে ঘর বরাদ্দ দেওয়া পরিবারগুলোর কাছ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা।

বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের রামদেব গ্রামের মৃত আবদুল হাইয়ের স্ত্রী রাহেলা বেগম। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ২ বিঘা জমিজুড়ে একটি পাকা ঘর ও পাঁচটি টিনশেড ঘর ও গাছের বাগান রয়েছে। তার দুই ছেলের আলাদা আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দু’টি মোটরসাইকেল রয়েছে। অথচ রাহেলার নামেও দেওয়া হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। তালিকায় ১০ নম্বরে রয়েছে তার নাম।

এ ব্যাপারে রাহেলার দাবি, ‘তালিকায় আমার নামে আছে। তবে চেয়ারম্যানকে বলে ঘর বরাদ্দ নিয়েছি মূলত আমার বিধবা মেয়ের জন্য।’

তালিকার ১৫ নম্বরে রয়েছে এ ইউনিয়নের সাতগীরি গ্রামের মাহবুল ইসলাম ও ১৬ নম্বরে রয়েছে পাইটকাপাড়ার কলিমন নেছার নাম, যারা সম্পর্কে আপন ফুপু-ভাতিজা। তাদের উভয় পরিবারের বসতভিটেয় একাধিক টিনশেড ঘর রয়েছে। আবাদি জমি ও কর্মজীবী হওয়ায় তাদের পরিবারে সচ্ছলতা আছে। অথচ ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের নামে। দেওডোবা গ্রামের মকবুল হোসেনের স্ত্রী শেপালি বেগম ও ছেলে হারুন মিয়ার স্ত্রী শেফালী সরকারের নামেও ঘর বরাদ্দ হয়েছে, যারা মূলত সচ্ছল।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাওয়া সচ্ছল এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

রামদেব গোয়ালপাড়ার জয়ন্তি রানী বলেন, ‘নিজের জায়গা জমি নেই। ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। টানাপড়েনের সংসার। নানা চেষ্টা করেও ১৫-২০ হাজার টাকা জোগার করতে পারিনি। তাই ঘর মেলেনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই গ্রামের এক বৃদ্ধা বলেন, ‘ঘর দেওয়ার নামে চেয়ারম্যান আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু সেই টাকা জোগার করতে না পারায় আমার নামে ঘর বরাদ্দ দেননি চেয়ারম্যান।’

আরও কয়েক জন গৃহহীনের অভিযোগ, ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারম্যান নজমুল হুদা। তালিকায় একই পরিবারের দুই জনের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুমন নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রত্যেক পরিবারের কাছে টাকা আদায় করেন চেয়ারম্যান। ফলে আবেদন করেও ঘর বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা।

ঘর বরাদ্দে অনিয়মের কারণে ক্ষুব্ধ বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সদস্যরাও। তাদের অভিযোগ, ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রকৃত ভূমিহীনদের নামে ঘর বরাদ্দের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

এ নিয়ে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য আমিনুল ইসলাম শওদাগরের অভিযোগ, ‘বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে ২২ জনের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৭ জনকে চিহ্ণিত করতে পারলেও বাকি পাঁচ জনকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তাদের নামের তালিকা প্রকাশেও গড়িমসি করছেন চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইউএনও-র যোগসাজশে চেয়ারম্যান ইচ্ছেমতো সচ্ছল ও পছন্দের লোকদের ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। এ নিয়ে অভিযোগ করে কোনও প্রতিকার মেলেনি। উল্টো হুমকি-ধামকি দেয় চেয়ারম্যান।’

অনিয়মের অভিযোগ মানতে নারাজ বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নজমুল হুদা। তিনি বলেন, ‘ঘর বরাদ্দে আমার ইউনিয়নে কোনও অনিয়ম হয়নি। ঘর বরাদ্দে কারও কাছ থেকে টাকাও নেওয়া হয়নি। তবে আমার নাম করে কেউ কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছে কিনা, জানা নেই।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন এই বাড়ির মালিকও

শুধু বামনডাঙ্গা নয়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, ঢোপাডাঙ্গা ও  রামজীবন ইউনিয়নেও। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের ১৫-২০ হাজার টাকা দিতে না পারায় এসব ইউনিয়নের দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পায়নি।

এ ব্যাপারে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক প্রভাষক আদুল্লাহ্ আল মেহেদী রাসেল বলেন, ‘৩৫৭টি ঘর বরাদ্দেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা ও ইউপি চেয়ারম্যানরা টাকা নিয়ে ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। বামনডাঙ্গা, তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, ঢোপাডাঙ্গা ও রামজীবন ইউনিয়নে খোঁজ নিলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি ঘর নির্মাণে একলাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির চেয়ারম্যানরাই এসব অনিয়ম-দুর্নীতি করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।’

সুন্দরগঞ্জের ইউএনও এসএম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ঘর বরাদ্দে কোনও অনিয়মের অভিযোগ আমার জানা নেই। এ নিয়ে কেউ অভিযোগও করেনি। তবে অনিয়মের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হবে। তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তি থাকলে তাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগও তদন্ত করা হবে। এ ছাড়া, বরাদ্দের অর্থে প্রতিটি ঘর নীতিমালা অনুযায়ী নির্মাণ করা হবে। এসব ঘর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রড, সিমেন্ট, ইট, বালু উপজেলা কার্যালয়ের দায়িত্বে কিনে দেওয়া হয়েছে। এরপরও কোনও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামিম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘ঘর বরাদ্দের অনুমোদন ও তালিকার বিষয়ে কিছু জানা নেই আমার। এসব ঘর বরাদ্দ অনেক আগেই হয়েছে। তবে যেহেতু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু ডিসি ও ইউএনও-কে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের মাঝে ঘর বরাদ্দ এবং সরকারের মহৎ উদ্দেশ বাস্তবায়নে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করলে হামাস ক্ষমতায় থেকে যাবে: নেতানিয়াহু
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করলে হামাস ক্ষমতায় থেকে যাবে: নেতানিয়াহু
ব্যাংক চলাকালীন এনবিআরকে অভিযান চালাতে হবে: হাইকোর্ট
ব্যাংক চলাকালীন এনবিআরকে অভিযান চালাতে হবে: হাইকোর্ট
যেভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করলে চুল মোলায়েম হবে
যেভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করলে চুল মোলায়েম হবে
জিএসটির ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
জিএসটির ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?