X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবিত স্বজনদের মৃত দেখিয়ে জামিন, তিন আসামি লাপাত্তা!

আলমগীর চৌধূরী, জয়পুরহাট
১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ২০:৩১আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ২০:৩২

জয়পুরহাট

মাদকের মামলায় হাজতে থাকা পৃথক মামলার তিন আসামি তাদের জীবিত স্বজনদের মৃত দেখিয়ে অন্তবর্তীকালীন জামিন নিয়ে হাজত থেকে বের হয়ে গেছেন। এরপর আদালতে হাজিরার দিন আর উপস্থিত হননি দুই আসামি, ফলে তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। অন্যজনের হাজিরার দিন আগামী বুধবার, তবে তিনিও লাপাত্তা। জানা গেছে, জয়পুরহাট থানার মাদক মামলায় একজন এবং পাঁচবিবি থানায় দায়ের করা মামলার আরও দুই আসামি এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে সবার জামিন শুনানিতে অংশ নিয়েছেন একই আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি। কিন্তু পরবর্তীতে এসব ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনের দাখিলের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন আদালত। পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, আসামিরা তাদের যে স্বজনদের মৃত দেখিয়েছেন তারা সবাই বেঁচে আছেন।   

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে তিন জনের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ইব্রাহিম হোসেন (৩০) জয়পুরহাট সদর থানার ১৫ নম্বর মামলার আসামি, আমির হোসেন ওরফে সোহেল (২৬) পাঁচবিবি থানার ৫৬ নম্বর এবং আতোয়ার হোসেন (৩৫) একই থানার ৬৩ নম্বর মামলার আসামি। তাদের জামিন নেওয়ার সময় ইব্রাহিম হোসেনের জীবিত বোন আনোয়ারা বেগম, আমির হোসেনের জীবিত স্ত্রী ইয়াসমিন এবং আতোয়ার হোসেনের জীবিত বাবা নাজির উদ্দিনকে মৃত দেখানো হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মৃত্যু সনদপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে ওইসব সনদ জাল ও ভুয়া দাবি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে মামলার রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীর কাছে প্রত্যয়নপত্র পাঠানো হয়েছে। মৃত ব্যক্তিরা জীবিত আছেন বলেও জানানো হয়েছে সেই প্রত্যয়নপত্রে।

এদিকে এসব ঘটনা জানাজানি হওয়ায় আদালতে হাজিরার জন্য নির্ধারিত দিনে জামিনে থাকা আতোয়ার ও ইব্রাহিম উপস্থিত না হওয়ায় ইতোমধ্যে তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এছাড়াও ২৩ জানুয়ারি আদালতে উপস্থিত হওয়ার দিন ধার্য আছে আমীর হোসেন সোহেলের।

আসামিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে থানা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর জয়পুরহাট শহরের বিশ্বাসপাড়া এলাকা থেকে ১০ পিস ইয়াবাসহ ইব্রাহিম হোসেনকে গ্রেফতার করে মাদকবিরোধী আভিযানিক দল। ওইদিনই জয়পুরহাট সদর থানায় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। আমীর হোসেনকে গত বছরের ১৯ নভেম্বর পাঁচবিবি পৌরসভার বালিঘাটা বাজার কলোনির বাড়ি থেকে ২০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশ আটক করে। পরের দিন ২০ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে তাকে আদালতের মাধ্যমে জয়পুরহাট জেলহাজতে পাঠানো হয়। একইভাবে আতোয়ারকে ১৮ বোতল ফেনসিডিলসহ গত বছরের ২১ নভেম্বর পাঁচবিবির আয়মা রসুলপুরের ছোট মানিক মোড় থেকে ইজিবাইকসহ পুলিশ আটক করে। ওইদিন রাতেই ইজিবাইক চালকসহ তার বিরুদ্ধে পাঁচবিবি থানায় মামলা করে জেলহাজতে পাঠানো হয়।  

এদিকে আদালত সূত্রে জানা গেছে, জেলা জজ আদালতে আসামি আতোয়ার হোসেনের উপস্থিত হওয়ারি দিন ধার্য ছিল ৮ জানুয়ারি। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর তার জীবিত পিতা নাজির উদ্দিনকে মৃত দেখিয়ে তার আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি জামিন প্রার্থনা করেন। মৃত্যুর প্রমাণ হিসেবে বাগজানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হকের স্বাক্ষর করা মৃত্যুর প্রত্যয়নপত্রও দাখিল করা হয় আদালতে। আদালত বিষয়টি বিবেচনা করে আসামি আতোয়ারকে অন্তবর্তীকালীন জামিনের আদেশ দেন। ৮ জানুয়ারি আতোয়ার হাজির না হওয়ায় জেলা জজ আদালতের বিচারক মমতাজ পারভিন জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন এবং আতোয়ারের পিতার মৃত্যুর বিষয়ে পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বজলার রহমান ১৪ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তিনি জানান, আসামি আতোয়ারের বাবা নাজির উদ্দিন জীবিত আছেন।   

এ ব্যাপারে আতোয়ার হোসেনের বাবা নাজির উদ্দিন বলেন, ‘ছেলে হাজতে থাকায় আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি ও তার মুহুরির কাছে জামিনের জন্য যাই। তারা আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেয়। ছেলের জামিনের পর জানতে পেরেছি আমাকে মৃত দেখিয়ে ছেলের জামিন নেওয়া হয়েছে। এখন বাড়িতে পুলিশ আসছে, সাংবাদিক আসছে। আমরা এর কিছু জানি না।

বাগজানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হক বলেন, ‘আসামি আতোয়ার হোসেনের বাবা নাজির উদ্দিন বেঁচে আছেন। তাকে মৃত দেখিয়ে আমার পরিষদের জাল প্রত্যয়নপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আমি আইনজীবী সমিতিকে বিষয়টি জানিয়েছি।’

একইরকম ঘটনা ঘটিয়েছেন আমীর হোসেন সোহেল। ২৩ জানুয়ারি তাকে আদালতে উপস্থিত করার কথা তার। কিন্তু তার স্ত্রী ইয়াসমিনের মত্যৃর সনদ দাখিল করে তার জন্য ৩১ ডিসেম্বর অন্তবর্তীকালীন জামিন করে নেন আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি। পাঁচবিবি পৌর মেয়রের প্রত্যয়নপত্র জমা দেন আদালতে। আদালতকে আরও জানানো হয়, আসামি আমীরের স্ত্রী ইয়াসমিন জামিনের দিন প্রসব বেদনায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

আমীর হোসেন সোহেল এর মা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমীরের জামিনের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমরা আইনজীবীকে কোনও কাগজপত্রও দেইনি। পরে শুনেছি বউমা ইয়াসমিনকে মৃত দেখিয়ে আমীরের জামিন করা হয়েছে। যা করেছে আইনজীবী করেছে আমরা কিছুই জানি না।’ 

পাঁচবিবির পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘আমীর হোসেন সোহেলের স্ত্রী ইয়াসমিনকে মৃত দেখিয়ে আমার পরিষদ থেকে একটি মিথ্যা ও জাল মৃত্যুর প্রত্যয়নপত্র আদালতে দেখানো হয়েছে। বিষয়টি জানার পর আমি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছে লিখিত দিয়ে জানিয়েছি- ওই মৃত্যুর সনদ আমার পরিষদ থেকে ইস্যু করা হয়নি। আসামির স্ত্রী ইয়াসমিন বেঁচে আছেন।’ 

অপর আসামি ইব্রাহিম হোসেনকেও জামিন নিয়ে দেন আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি। ১৪ জানুয়ারি ইব্রাহিমের হাজির হওয়ার কথা ছিল আদালতে। কিন্তু তার বোন মারা যাওয়ার কথা বলে এবং মিথ্যা তথ্য-প্রমাণ জমা দিয়ে ১৯ ডিসেম্বর ইব্রাহিমকে জামিনে করে নেন আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি। এক্ষেত্রে তিনি কৌশলে জামিনের আবেদন পত্রে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুলতান আলম মোল্লার স্বাক্ষর নিলেও শুনানিতে তিনি নিজেই অংশ নিয়েছেন। তিনি আদালতকে জানান, আসামির বোন আনোয়ারা বেগম ১৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আইনজীবীর দাখিল করা তথ্য প্রমাণ বিবেচনা করে পরবর্তী ধার্য তারিখ ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ইব্রাহিমের অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন অবকাশকালীন জজ এ বি এম মাহমুদুল হক। কিন্তু ১৪ জানুয়ারি ইব্রাহিম আদালতে হাজির না হওয়ায় তার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন জেলা জজ আদালতের বিচারক মমতাজ পারভিন। একই সঙ্গে তিনি আসামির বোনের মৃত্যুর বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

এ ব্যাপারে ইব্রাহিমের বোন আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার বাবা আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলেন ভাইয়ের জামিনের জন্য। কিন্তু কোনও কাগজ আমরা সরবরাহ করিনি। জামিন নিয়ে দিয়েছেন আইনজীবী। আর আমি বিয়ের পর অন্য গ্রামে থাকি। এসবের সাথে আমাদের কোনও সম্পৃক্ততা নাই। এখনিআমরা এসব জানতে পেরেছি।’

এদিকে এই তিন মামলার আইনজীবী নাজমুল ইসলাম জনি তিনটি মামলাতেই জামিন শুনানিতে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি জানান, আসামিদের জন্য তদবিরকারীদের দেওয়া তথ্যই আদালতে উপস্থাপন করেছেন। নিজে থেকে তিনি কোনও নথি তৈরি করেননি। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নাজমুল ইসলাম জনি আরও বলেন, ‘অবকাশকালীন আদালতে তদবিরকারীদের দেওয়া তথ্য ভুল না সঠিক তা ব্যাখ্যা করার সুযোগ নাই। আমরা সরল বিশ্বাসে তাদের দেওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করি।’

জয়পুরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, ‘মাদকের তিন মামলার আসামির বাবা, স্ত্রী ও বোন জীবিত থাকার পরও তাদের মৃত দেখিয়ে অবকাশকালীন আদালত থেকে জামিন নেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমরা চাই তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’ এমনকি আইনজীবীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সে ব্যাপারেও আইন নিজের পথেই চলবে বলেও জানান তিনি। 

এ ব্যাপারে পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলার রহমান বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে জামিন নেওয়া তিনটি মামলার বিষয়ে আদালত থেকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ পেয়ে তিনটি ঘটনারই প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। মৃত দেখানো ব্যক্তিরা সবাই জীবিত আছেন।’ 

 

 

   

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে