X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চের অভাবে ধুঁকছে নারায়ণগঞ্জের থিয়েটার শিল্প

আরিফ হোসাইন কনক, নারায়ণগঞ্জ
২৭ মার্চ ২০২৩, ১৩:১০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ২২:১১

মঞ্চের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে নারায়ণগঞ্জের থিয়েটার শিল্প। এক সময় জেলায় একমাত্র নাট্য চর্চার স্থান ছিল শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন। তবে পাঠাগার ভবনের সংস্কার কাজসহ নানা জটিলতায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থিয়েটার কর্মীরা সেখানে নাট্যচর্চা করতে পারছেন না। ফলে অধিকাংশ থিয়েটার কর্মীরা নাট্যচর্চায় বিমুখ হয়ে পড়েছেন।

তবে এখনও কেউ কেউ অন্য পেশার পাশাপাশি থিয়েটারকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন, নাট্যশিল্পকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অর্থ সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে থিয়েটার শিল্প ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে।

শহরে দীর্ঘদিনের পুরনো আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনে এক সময় নাট্য চর্চা করতো থিয়েটার কর্মীরা। তবে ২০১০ সালে পুরনো পাঠাগার ভবনটি ভেঙে ছয়তলা ভবনের কাজ শুরু করা হয়। ২০১৭ সালে ভবনের কাজ শেষ হয়। তবে ওই ভবনে নাট্যচর্চা করার রিহার্সাল রুম নেই। এ ছাড়া নাটক পরিবেশন করার হল রুম থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল। ফলে সেখানে নাট্যচর্চার কোনও সুযোগ নেই। 

সংকটের মধ্যে কয়েক বছর আগে থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা জেলায় হল রুমের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন উদ্বোধন করা হয়। তবে সেখানে হল রুম ভাড়া হিসেবে প্রতি ঘণ্টার জন্য তিন হাজার টাকা গুনতে হয়। সে হিসেবে একটি নাটকের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়। এতো টাকার জোগান দেওয়া অসম্ভব বলে নাট্যচর্চায় বাধা রয়েই গেছে।

কবর নাটকের দৃশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ৬টি থিয়েটার সংগঠন রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সংগঠনগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ থিয়েটার, সংশপ্তক নাট্যদল, জনে জন নাট্য সম্প্রদায়, সিরাজউদ্দৌলা নাট্যদল, উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদ, ঐকিক থিয়েটার। এ ছাড়া রয়েছে উঠান থিয়েটার, নাটুয়া, নারায়ণগঞ্জ নাট্যাঙ্গন, এই বাংলায়, শ্রুতি, মাসদাইর থিয়েটারসহ প্রায় ১২টির মতো থিয়েটার নাট্যদলের সংগঠন। নাটক চর্চার স্থান সংকটের মধ্যে ঐকিক থিয়েটার রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নাটক করেছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি নাট্যদল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাটক চর্চা করছে। 

উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান জেমস বলেন, ‘এ জেলার থিয়েটার শিল্পীরা ভালো নেই। এখানে থিয়েটার চর্চা করার জায়গা নেই। জেলা শিল্পকলা ও চুনকা পাঠাগারে নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু চর্চা করার ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া শিল্পকলা ও চুনকা পাঠাগারের হলরুমে অনেক টাকা ভাড়া দিতে হয়। এক দিনের একটা শোর জন্য ৩০ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এতো টাকার জোগান দেওয়া অসম্ভব। তাছাড়া থিয়েটারের কথা জানতে পারলে কোনও বাড়ির মালিক ঘর ভাড়া দেয় না। তবে এতো সংকটের মধ্যেও অনেকগুলো নাটক আমরা করেছি।’

থিয়েটার শিল্পী হলেও জীবিকা নির্বাহের জন্য ৮ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকে চাকরি করে আসছেন রাকিবুল হাসান জেমস। বর্তমানে তিনি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তবে থিয়েটার করা নেশায় পরিণত হয়েছে। এ কারণে চাকরির পাশাপাশি থিয়েটার করে আসছি। কিছুদিন আগে আমার পরিচালনায় ব্ল্যাক আউট নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে অনেক কর্মী সংকট রয়েছে। এই সংগঠনে সক্রিয় ২০ জন কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে আট জন নারী কর্মী। আমাদের সমাজে ছেলেমেয়েরা টিকটক করছে। অথচ থিয়েটারের জন্য শিল্পী পাচ্ছি না। নবম শ্রেণি থেকে অনার্স প্রথম বর্ষ পর্যন্ত নারী শিল্পী পাওয়া যায়। এর পরে সেই নারী শিল্পীদের বিয়ে হয়ে যায়। তা ছাড়া থিয়েটার করে কোনও শিল্পীর জীবিকা নির্বাহ করার মতো পরিস্থিতি নারায়ণগঞ্জে তৈরি হয়নি। ফলে দিন দিন থিয়েটার শিল্পী কমে যাচ্ছে।’ 

অভিনেতা ও উঠান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা শোহেব মনির বলেন, ‘সব কলার সমন্বয় হচ্ছে নাট্যকলা। অথচ এই নাট্য শিল্প ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ হারাচ্ছে। আলী আহাম্মদ পৌর চুনকা পাঠাগার সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন এ জেলায় নাট্যচর্চা বন্ধ ছিল। ফলে নাট্য দলগুলো গুছিয়ে উঠতে পারছে না। এ ছাড়া নাটক করতে টাকার প্রয়োজন। অর্থ জোগান দেওয়ার স্পন্সর নেই। এতো সংকটের মধ্যেও আমরা নাটক করেছি।’

ব্ল্যাক আউট নাটকের দৃশ্য থিয়েটার ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করান শোহেব মনির। তিনি বলেন, ‘ভর্তুকি দিয়ে উঠান চারু-নাট শিক্ষাঙ্গন নামে একটি সাংস্কৃতিক স্কুল পরিচালনা করে আসছি। এ ছাড়া উঠান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার এখানে প্রায় ৩০ জন শিল্পী রয়েছেন, যার মধ্যে আট জন নারী শিল্পী। নারী কর্মী সংকটের ফলে নাটক তুলতে পারছি না। আর যে কয় জন নারী শিল্পী রয়েছেন তারা যথাযথ সময় দিতে পারছে না। কারণ থিয়েটার দিয়ে তাদের কোনও উপার্জন নেই।’
 
৫০ বছর ধরে থিয়েটার নিয়ে কাজ করছেন জনে জন নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বাহাউদ্দিন ভুলু। তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবন সংস্কারের পরে থিয়েটার নাটকের বেহাল দশা শুরু হয়। ওই সময়ের আগে চুনকা পাঠাগারে ঘণ্টায় ২০ টাকা ভাড়া হিসেবে নাটক চর্চা করার সুযোগ ছিল। চুনকা পাঠাগারের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলেও সেখানে থিয়েটার নাটক করার রিহার্সাল রুম নেই। ফলে এক যুগের বেশি সময় ধরে থিয়েটার শিল্পীরা নাট্য চর্চা করতে পারছেন না। শিল্পীরা থিয়েটার থেকে দূরে সরে গেছে। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন চালু হয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রতি ঘণ্টা হিসেবে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এতো টাকা খরচ করে থিয়েটার করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলার মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। এ ছাড়া সরকারিভাবে আমাদের বছরে কিছু টাকা দেওয়া হয়। তবে সেটা যথেষ্ট নয়।’ 

নারী কর্মী সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের ৩৩ জন শিল্পী কর্মী রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র তিন জন নারী। নারী কর্মীর সংকট রয়েছে। নারী কর্মীদের যাতায়াত ভাড়াসহ তাদের পেছনে আরও অনেক খরচ রয়েছে। অর্থ সংকটের ফলে এসব খরচ সেভাবে বহন করা সম্ভব হয় না। যে কারণে সংকট দেখা দিয়েছে।’

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা বলেন, ‘থিয়েটারের কর্মী দিন দিন কমছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। আর নারী কর্মীদের মধ্যে অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। ২৫ জন কর্মী নিয়ে আমাদের সংগঠন চলছে। এর মধ্যে মাত্র একজন নারী কর্মী রয়েছে। একজন নারী কর্মী দিয়ে সংগঠনের কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। জিয়া হল বন্ধ থাকায় আমরা দীর্ঘদিন পথে পথে ঘুরেছি। পরে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন করা হয়েছে। এখন অন্তত আমাদের একটা গতি হয়েছে।’

জেলা কালচারাল কর্মকর্তা রুনা লায়লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মঞ্চের সংকট এখন অনেকটা কমে এসেছে। জেলায় শিল্পকলা একাডেমির অডিটোরিয়ামে নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে দুই ঘণ্টায় ৬ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এই ভাড়া আগে ১৬ হাজার টাকার অধিক ছিল, পরবর্তীতে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এই ভাড়ার টাকা কমিয়ে ৬ হাজার টাকা করেছে। এ ছাড়া নাটক মহড়ার জন্য দুই সিফটটের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি সিফটে ১০০ টাকা করে ভাড়া রাখা হয়। তবে নারী শিল্পীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। নারীদের থিয়েটার করার বিষয়টি পরিবার থেকে অনেক সময় সমর্থন দেওয়া হয় না। এ ছাড়া আধুনিক যুগের টিকটকসহ মোবাইলে নানা ভিডিও কনটেন্টের ফলে থিয়েটার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আশা করছি, অচিরেই থিয়েটার শিল্প তার জৌলুস ফিরে পাবে।’

/এসএন/আরআর/
সম্পর্কিত
অভিনেতা জোভান-মাহিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
ফুটবলার রুপনাকে নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ
দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে ‘বউ শাশুড়ি’ যুদ্ধ!
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছর
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছর
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক