X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা দেখে উত্তাল হয়ে ওঠে পটুয়াখালী

আবদুল কাইউম, পটুয়াখালী প্রতিনিধি
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:২৭আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৫০

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবদুস সালাম। তার রক্তামাখা জামা পটুয়াখালীতে নিয়ে আসা হয়। সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে আয়োজিত গণজমায়েতে রক্তামাখা জামা মানুষকে দেখানোর পরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পটুয়াখালী। এতে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের ঢেউ পটুয়াখালীতেও আছড়ে পড়ে।

তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে পটুয়াখালীতে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের অনেকেই এখন জীবিত নেই। এস এম আবুল হোসেন আবু মিয়া ও মো. দলিল উদ্দিন আহমেদ নামের দুই ভাষা সৈনিকের সঙ্গে কথা হয়।

তারা জানান, তখন পটুয়াখালী ছিল বরিশাল জেলার একটি মহকুমা। ঢাকায় যখন ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় পটুয়াখালীতে ‘পটুয়াখালী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে কবি খন্দকার খালেককে আহ্বায়ক ও জালাল উদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। পরে এ কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। কমিটিতে উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন আজহার উদ্দিন, আবুল হোসেন আবু মিয়া, অ্যাডভোকেট এমদাদ আলী, বীরেশ্বর বসু, অতুল চন্দ্র দাস, ধ্রুবজ্যোতি দত্ত, অ্যাডভোকেট গোলাম আহাদ চৌধুরী, এটিএম ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ।

ওই কমিটিতে না থাকলেও ভাষা আন্দোলনে পটুয়াখালীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পটুয়াখালীর বাউফলের সন্তান সৈয়দ আশরাফ হোসেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ কমিটির উদ্যোগে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও পটুয়াখালী শহরে হরতাল পালন করা হয়। পটুয়াখালীতে খবর আসে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণ ও শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে শহীদ হন সালাম। তার মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ আশরাফের বড় ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার সৈয়দ ফজলুল হক। ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা নিয়ে সৈয়দ আশরাফ হোসেন পটুয়াখালীতে আসেন। 

২৩ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী শহরের বড় মসজিদ সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ভাষা আন্দোলন কমিটির প্রথম প্রকাশ্য জনসভা। এমদাদ আলীর সভাপতিত্বে ওই সভায় বিডি হাবিবুল্লাহ, এবিএম আব্দুল লতিফ, আব্দুল করিম মিয়া, সৈয়দ আশরাফসহ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীরা বক্তব্য দেন। ছাত্র-জনতা ছাড়া ওই সভায় তেমন লোক ছিল না। শহীদ সালামের রক্তমাখা জামাটি দেখানোর পরে পটুয়াখালীর মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলনে যোগ দেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা। 

patuakhali

ভাষা সৈনিক মো. দলিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা থেকে নিয়ে আসা শহীদ সালামের রক্তমাখা জামাটি বিভিন্ন সভায় জনতাকে দেখান সৈয়দ আশরাফ। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে উপস্থিত জনতা, আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল হয়ে ওঠে পটুয়াখালী। জনসভায় ঘোষণামতে ৩ মার্চ পটুয়াখালী শহরে পালন করা হয় সর্বাত্মক হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল। এর আগে পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। ওই গণজমায়েতে পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ অনেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায়ও রক্তমাখা জামাটি দেখানো হয়। রক্তমাখা জামাটি ছুয়ে আমরা সবাই শপথ নিই বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়ার। পরে জুবিলী স্কুলের মাঠ থেকে আমাদের ‘রক্ত শপথ’ গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পরে।’

তবে স্থানীয় প্রশাসন জুবিলী স্কুলের মাঠের গণজমায়েতকে পণ্ড করতে নানা কৌশল নেয় বলে জানান দলিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। জনসভায় বিতরণের জন্য আন্দোলনকারীদের অন্যতম কবি খন্দকার খালেক রচিত ‘রক্ত শপথ’ লিফলেট আর্ট প্রেস নামক ছাপাখানায় ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। শহরে মোতায়েন করা হয় দাঙ্গা পুলিশ। কিন্তু ছাত্র-জনতার ঢল নামে পটুয়াখালী শহরের সরকারি জুবিলী স্কুল মাঠে। গণজমায়েত স্মরণকালের বৃহৎ জনসভায় রূপ নেয়। এতে গ্রাম থেকেও নৌকায় ছুটে আসেন ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। অ্যাডভোকেট এমদাদ আলী এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। জনস্রোত দেখে দাঙ্গা পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। এদিকে ‘রক্ত শপথ’লিফলেট ছাপানোর কারণে তৎকালীন প্রশাসন সরকারি কাজের ক্ষেত্রে আর্ট প্রেসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যা পরের পাঁচ বছর বলবৎ ছিল।’

ভাষা সৈনিক এস এম আবুল হোসেন আবু মিয়া জানান, পরে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পটুয়াখালীতে একটি পাঠাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে ১৭ এপ্রিল পটুয়াখালীর পুরান বাজার স্টিমার ঘাটের একটি বাড়ির দোতলায় প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন যুক্তফ্রন্টের এমপি আব্দুল করিম মিয়া ও সম্পাদক হন জালাল উদ্দিন আহমেদ। পরে কয়েকটি স্থানে স্থানান্তরের পর শহরের এসডিও অফিসের পুকুরের পশ্চিম উত্তর কোণে নিজস্ব ভবনে নির্মিত হয় পটুয়াখালী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার যার কার্যক্রম এখনও সচল।  

আবু মিয়া জানান, ২৫ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন পাঠাগারের। বর্তমানে ৩৬ জন আজীবন সদস্যসহ ১০০ জন সদস্য রয়েছেন। পাঠাগারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলা বর্ষবরণ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকের আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক মানুষ পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন লেখক-কবিদের বই পড়েন। 

ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ চত্বরে ১৯৬৩-৬৪ অর্থবছরে স্থাপিত হয় শহীদ মিনার। পটুয়াখালী জেলার প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই কাঠামোটি। যেখানে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। 

/আরআর/
সম্পর্কিত
তাসখন্দে শহীদ মিনার স্থাপনের প্রস্তাব
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তী পালন করবে ইউনেস্কো
গানে গানে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন