X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

জেলেদের টিকে থাকাই দায়

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা
০৪ জুন ২০২৩, ০৮:০১আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ০৮:০১

বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৫৭ দিন সমুদ্রে ইলিশ শিকার করতে পারেন উপকূলের জেলেরা। বাকি ২০৮ দিন অলস সময় কাটাতে হয়। নিষেধাজ্ঞার সময়ে কেউ ঘরে বসে থাকেন, কেউ আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। এই সময়ে আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটান। অনেকে ধারদেনায় জর্জরিত। এ অবস্থায় জেলেদের টিকে থাকাই এখন দায়।

জেলেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে ঘরে বসে থাকায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছেন জেলে, ঘাট শ্রমিক, ট্রলার মালিক, আড়তদার ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বছরের পর বছর ঋণগ্রস্ত থাকায় কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

কয়েকজন জেলে ও মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা ও মাছের বংশবিস্তারে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপর ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা দেয় মৎস্য অধিদফতর। সেইসঙ্গে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় বছরে গড়ে ৪৫ দিন সমুদ্রে যেতে পারেন না জেলেরা। নিষেধাজ্ঞার ৮৭ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে ৪৫ দিনসহ ১৩২ দিন বাদে জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ পান সাত মাস সাত দিন।

নিষেধাজ্ঞার সময়ে কেউ ঘরে বসে থাকেন, কেউ আড্ডা দিয়ে সময় কাটান, কেউ ট্রলার মেরামত করেন

ট্রলার মালিক ও জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, মাসে দুই বার সাগরে মাছ ধরতে যান জেলেরা। প্রতিবার মাছ ধরা শেষে ঘাটে ফিরে বিক্রি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। হিসাবে একটি ট্রলার মাসে সাত-আট দিন ঘাটে থাকে। মাছ ধরার নির্ধারিত সময় সাত মাসের মধ্যে ৫৬ দিন কেটে যায় ঘাটে। এ ছাড়া প্রতিটি ট্রলার তিন মাস পরপর মেরামত করতে হয়। প্রতিবার মেরামতে সময় লাগে পাঁচ দিন। এতে বছরে চারবারে সময় যায় ২০ দিন। সবমিলিয়ে বছরে ২০৮ দিন সমুদ্রে যেতে পারেন না। বাকি ১৫৭ দিন সাগরে গেলেও সবসময় ইলিশ পাওয়া যায় না। এতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কলাপাড়া উপকূলের জেলেরা। 

কলাপাড়ার জেলে দুলাল হোসেন বলেন, ‘১৫৭ দিন সাগরে গেলেও সবসময় মাছ পাওয়া যায় না। আবার অনেক জেলে অসুস্থ হন, কেউ ডাকাকের কবলে পড়েন। এতে আরও সময় যায়। ফলে বলা যায়, বছরে ১৩০-১৪০ দিন মাছ ধরার সময় পাই আমরা। বছরের বাকি সময় ঘরে বসে অলস কাটাতে হয়। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তাই অন্য পেশা খুঁজছি।’

কলাপাড়ার আরেক জেলে মো. সোবহান বলেন, ‘মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়টা আসলে অনেক বেশি। বেকার বসে থাকতে হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্ট করতে হয়। এ জন্য দুটি নিষেধাজ্ঞার সময় মিলিয়ে একটি করার দাবি জানাচ্ছি।’ 

মাসে দুই বার সাগরে মাছ ধরতে যান জেলেরা

কুয়াকাটা উপকূলে নিষেধাজ্ঞার সময়ে মাছ ধরি না উল্লেখ করে সোবহান আরও বলেন, ‘এ সময়ে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। মৎস্য অধিদফতর ও নৌবাহিনীর টহল জোরদারের দাবি জানাচ্ছি।’

জেলেরা বছরে ১৫৭ দিন মাছ ধরার সুযোগ পান জানিয়ে এফবি সাইম ট্রলারের মাঝি রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘৮৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা অনেক বেশি সময়। এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়া, সমুদ্র উত্তাল, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ের কারণে বছরে ৪৫-৫০ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে। প্রতি তিন মাস পরপর ট্রলার মেরামত করতে সময় লাগে ২০-২৫ দিন। প্রতি ট্রিপে ঘাটে সময় ব্যয় হয় তিন-চার দিন। সবমিলিয়ে  বছরের বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে থাকতে হয় জেলেদের। এতে দিন দিন ঋণগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। শুধু জেলেরা নয়, মৎস্য পেশায় জড়িত সবার একই অবস্থা।’ 

ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কলাপাড়া উপকূলের জেলেরা

কলাপাড়ার ট্রলার মাঝি মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘মাসের পর মাস ঘরে বসে থেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় অনেকে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ অর্থ সংকটে ভোগেন। এভাবে চলতে থাকলে এই পেশা বিলীন হয়ে যাবে।’

বছরের বেশিরভাগ সময় জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় আমাদের ব্যবসা বন্ধ থাকে উল্লেখ করে কুয়াকাটার মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরাও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। কিছু ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। আমিও অন্য ব্যবসা খুঁজছি।’ 

এখন মাছ ব্যবসায় লাভ নেই জানিয়ে কলাপাড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান বলেন, ‘জেলেদের দাদন দিয়ে আটকা পড়েছি। দাদনের টাকা উঠাতে পারছি না, অন্য ব্যবসায়ও যেতে পারছি না। বাধ্য হয়ে ব্যবসা ধরে রেখেছি।’

সারা বছরই জেলেদের ধারদেনা করে চলতে হয় বলে জানালেন কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘এখানের ট্রলার মালিক ও জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে ঘরে বসে থাকেন। ধারদেনা করে সারা বছর সংসার চালান। এ সুযোগে অন্যান্য এলাকা ও ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে অবরোধ পুরোপুরি সফল হয় না।’

মাসের পর মাস ঘরে বসে থেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় অনেকে অন্য পেশায় যাচ্ছেন

এমন অভিযোগের বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যে অভিযান চালাই। যারা নিষেধাজ্ঞার সময়ে মাছ ধরে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

জেলেরা ১৫৭ দিন মাছ ধরতে পারেন, তবে প্রকৃতপক্ষে ২২ দিনই সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে উল্লেখ করে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘জাটকা নিধন বন্ধের যে আট মাস তখন কিন্তু জেলেরা অন্য জাল দিয়ে অন্যান্য মাছ ধরতে পারেন। তবে ৬৫ দিনের অবরোধের সময়ে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। তখন জেলেরা নদী ও খালে মাছ ধরতে পারেন। যারা অলস সময় কাটান, চাইলে অন্য কাজও করতে পারেন। নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রকৃত জেলেদের চাল দেওয়া হয়।’

অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ-পুলিশের বরিশাল অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন বলেন, ‘২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন কেউ মাছ ধরলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নদীতে নৌ-পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।’

/এএম/ 
সম্পর্কিত
চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ, ইউপি চেয়ারম্যান সমর্থক ও জেলেদের সংঘর্ষ
ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে সাগরে নিখোঁজ জেলে
সুন্দরবনের দুবলার চরকমেছে শুঁটকি উৎপাদন, কষ্টের কথা জানালেন জেলেরা
সর্বশেষ খবর
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ