বিভিন্ন রোগীর জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।এরপর তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে সাধারণ ফ্রিজে । পরে মুমূর্ষু কোনও রোগীর কাছে অধিক মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে এই রক্ত। খাগড়াছড়ির প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে এমনটাই অভিযোগ উঠেছে।
ডোনার ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ব্লাড ব্যাংক না থাকার পরও জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণ করছে ক্লিনিকগুলো। পরে চড়া মূল্যে বিক্রি করে এসব রক্তই রোগীদের শরীরে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও প্রশাসনিক কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
খাগড়াছড়ি ব্লাড ডোনারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. কায়েস বলেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলায় ব্লাড ডোনারস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, অরণ্যে তারুণ্য, স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবক ফোরামসহ চারটি সংগঠন রোগীদের জরুরি প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্ত দান করে। আর সেই রক্ত নিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ব্যবসা করছে। জেলা শহরের প্রায় সবগুলো ক্লিনিক লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে চলছে। এসব ক্লিনিকের কোনটিরই ব্লাড ব্যাংক না থাকলেও তারা অবৈধভাবে ফ্রিজে রক্ত সংরক্ষণ করছে। তারা রোগীদের আত্মীয়-স্বজনকে চাপাচাপি করে ডোনার সংগ্রহ করে। ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে, ক্রস ম্যাচ করে, এরপর রক্ত আর দরকার নেই বলে ব্লাড ব্যাগ ফ্রিজে রেখে দেয়। পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে তা অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রভাবশালীদের দ্বারা পরিচালিত খাগড়াছড়ি শেভরন প্রা. হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি প্রাইভেট হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি একতা ডায়গনস্টিক, চাঁদনী ডায়গনস্টিক, চেঙ্গী কাঁশবন হাসপাতাল ও লাইফ কেয়ার হাসপাতালে রক্ত সংগ্রহ, ক্রস ম্যাচ এবং রক্ত বিক্রি অব্যাহত থাকলেও এব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করছে না প্রশাসন।
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সুদর্শন দত্ত বলেন, ‘ডোনারদের রক্ত নিয়ে ব্যবসা কোনোভাবেই মানা যায় না।’ খাগড়াছড়ির প্রায় সব ক্লিনিকই অবৈধ উল্লেখ করে তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের প্রতি।
জেলা প্রশাসন ও জেলা সিভিল সার্জন সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯ উপজেলায় ৩৬টি বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে শুধু খাগড়াছড়ি জেলা শহরেই আছে ১০টি ক্লিনিক। এছাড়া মাটিরাঙা উপজেলায় ছয়টি, দিঘিনালা উপজেলায় পাঁচটি, রামগড় উপজেলায় চারটি, মানিকছড়ি উপজেলায় চারটি, মহালছড়ি উপজেলায় তিনটি, পানছড়ি উপজেলায় তিনটি ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় একটি ক্লিনিক রয়েছে। তবে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে অবস্থিত ক্লিনিকগুলো স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি ডোনারদের রক্ত নিয়ে ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগও উঠেছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতা শফিকুল ইসলামের অভিযোগ, গত ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এক রোগীর অপারেশনের জন্য ‘ও পজেটিভ’ রক্ত দিতে তিনি শহরের ‘চেঙ্গী কাঁশবন’ নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে যান। তার শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার শেষ হলে একজন নার্স জানান যে, সেদিন আর অপারেশন হবে না। তাই রক্তের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা রক্ত কী করা হবে তা জানতে চাইলে নার্স জানায়, ওই রক্ত পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য ফ্রিজে রেখে দেওয়া হবে। নার্সের কাছে বিষয়টি জানার পর ব্লাড ডোনারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের খবর দেন তিনি। এরপর তারা চেঙ্গী কাঁশবন হাসপাতালে গিয়ে ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। এরকম ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্লাড ব্যাংক না থাকার পরও বেসরকারি ক্লিনিকগুলো রক্ত ব্যবসা চালাচ্ছে। চিকিৎসকরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ে এসব ক্লিনিক ও ব্যবসা চালায় জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন।’
মেহেদী হাসান নামে আরেক রক্তদাতার অভিযোগ, ‘বিভিন্ন সময় শহরের ক্লিনিকগুলোতে অবৈধ রক্ত ব্যবসা চলে আসছে। ডোনাররা স্বেচ্ছায় রক্ত দিলেও এসব রক্ত নিয়ে ব্যবসা করছে ক্লিনিকগুলো। প্রতিব্যাগ রক্ত ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।’
জাকারিয়া হাসান নামের একজন ডোনার বলেন, ‘২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর একজনকে রক্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্লিনিকের লোকজন সে রক্ত রোগীকে না দিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়। ওই রক্ত ১ ডিসেম্বর আরেক রোগীর কাছে এটি বিক্রি করে। বিষয়টি জানতে পারার পর আমরা লাইফ কেয়ার কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করলে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু এবারও একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।’
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। বিক্ষুব্ধ লোকজন এর আগেও কয়েকটি ক্লিনিক ভাঙচুর করেছে। কয়েকদিন আগেও ভাঙচুর করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি গত ১৪ জানুয়ারি বিষয়টি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় তুলেছি। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছি। এরপরেও প্রশাসন সক্রিয় না হলে রক্ত ব্যবসায়ীদের ছাড়বেন না ভুক্তভোগীরা।’
এ ব্যাপারে কথা হয় ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ডা. টুটুল চাকমা, চেঙ্গী কাঁশবন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. দিব্য শেখর চাকমা ও চাঁদনী ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকের পরিচালক আকবর হোসেনের সঙ্গে। একই সুরে কথা বলেন তারা। তাদের সবারই দাবি, স্টাফদের ভুলের কারণে দু’একটি ঘটনা ঘটেছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া ফ্রিজে রক্ত সংরক্ষণের বিষয়টি তারা অস্বীকার করেছেন।
খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. শওকত হোসেন বলেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলার কোনও ক্লিনিকে রক্ত সংরক্ষণের অনুমতি নেই। যদি কেউ রক্ত সংরক্ষণ করেন তবে তা অবৈধ হবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডোনারদের রক্ত নিয়ে ব্যবসার বিষয়টি যেহেতু জেলা আইনশৃঙ্খলা সভাসহ বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হয়েছে, তাই এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্লিনিকগুলো কিভাবে চলছে এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে সিভিল সার্জনকে বলা হয়েছে। অবৈধভাবে চলতে থাকা ক্লিনিকসহ বৈধভাবে চলমান কোনও ক্লিনিকও যদি ডোনারদের রক্ত নিয়ে ব্যবসা করে তবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’