চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। বালু তোলার অনুমতি বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের (লিভ টু আপিল) পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৪ এপ্রিল) এ আদেশ দেন চেম্বার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। এ তথ্য বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।
তিনি বলেন, ‘বালু উত্তোলনের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায় ছিল, তার বিরুদ্ধে আমরা লিভ টু আপিল (হাইকোর্টের রায় বাতিল চেয়ে আবেদন) করেছিলাম। আজ আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি তা স্থগিত করেছেন। আগামী ২৫ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বালু উত্তোলনের অনুমতি বাতিলের বিষয়ে শুনানি হবে।’
কাজী মাঈনুল হাসান বলেন, ‘যারা এ ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করে ব্যক্তিগতভাবে অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তাদের জন্য এটি একটি মেসেজ। এ ধরনের কাজ করলে কোনও না কোনও সময় ধরা পড়বেই। অনেককে ম্যানেজ করে কিছু দিন বা অনেক দিন চলা যায়। কিন্তু একদিন ধরা পড়তেই হবে এবং আইনের আওতায় আসতে হবে। এটি অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ।’
২০১৫ সালে নৌপথ সচল করার কথা বলে রিট করেছিলেন চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় চার বছর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় মেঘনার ডুবোচর থেকে ৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
নথিপত্রে দেখা যায়, মেঘনা নদীতে (চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে অবস্থিত ২১টি মৌজা এলাকায়) জনস্বার্থে নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করেছিলেন সেলিম খান। রিটের ওপর ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে চাঁদপুরের ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের একটি চিঠির উল্লেখ করে বলা হয়, ওই মৌজাগুলোতে পর্যাপ্ত বালু-মাটি রয়েছে এবং তা তুলতে কোনও বাধা নেই।
হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয়। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়। কিন্তু নদী থেকে যত্রতত্র শত শত ড্রেজার বসিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে জাতীয় সম্পদ ইলিশ ক্ষতিগ্রস্ত, মাছের খাদ্য কমে যাওয়া, নদীভাঙন প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারার বলছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নদী থেকে নির্বিচারে বালু তোলার কারণে চাঁদপুরে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ভাঙন। ইলিশের আবাসস্থল ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
সর্বশেষ ১৫ মার্চ হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করা হয়। এক হাজার ৪৪০ দিন দেরিতে লিভ টু আপিল করায় বিলম্ব মার্জনাও চাওয়া হয়।
লিভ টু আপিলে বলা হয়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে কোনও নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ প্রতিবেদনই যে একক ভিত্তি নয়, তা হাইকোর্ট বিভাগ উপলব্ধি করতে পারেননি। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে, পরিবেশ, পাহাড়ধস, ভূমিধস অথবা নদী বা খালের পানির স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন, সরকারি স্থাপনার (যথা ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ফেরিঘাট, হাটবাজার, চা-বাগান, নদীর বাঁধ, ইত্যাদি) এবং আবাসিক এলাকার কোনও ক্ষতি হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামত গ্রহণ করবেন জেলা প্রশাসক।
এছাড়া কোনও বালুমহালে উত্তোলনযোগ্য বালু বা মাটি না থাকলে বা বালু বা মাটি উত্তোলন করার ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্ট বা সরকারি বা বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে ওই বালুমহাল বিলুপ্ত ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন জেলা প্রশাসক।
লিভ টু আপিলে বলা হয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ডুবোচরের বালু উত্তোলনের বিষয়ে কোনও ধরনের মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি রিটে উল্লিখিত মৌজাগুলো বিভাগীয় কমিশনার বালুমহাল হিসেবেও ঘোষণা করেননি। তাই হাইকোর্ট বিভাগ বিবাদীকে (সেলিম খান) বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাতিলযোগ্য।
লিভ টু আপিলের বিষয়ে কাজী মাঈনুল হাসান বলেন, ‘তিনি মামলাটি করেছেন জনস্বার্থের কথা বলে। আসলে এখানে জনস্বার্থের কিছু নেই। পুরোটাই ব্যক্তি স্বার্থ। এজন্য এখন থেকে বালু তুলতে পারবেন না ওই চেয়ারম্যান।’
তিনি বলেন, ‘এতদিন তারা গোপনে বালু তুলছিল না। বালু তোলার বিষয়টি সবারই জানার কথা। এতদিন সংশ্লিষ্টরা ব্যবস্থা নিলো না কেন? আদালতের রায় ছিল, সেটিও আমাদের দৃষ্টিগোচরে আনা হলো না। এখন বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে। তাই অ্যাটর্নি জেনারেলকে সব দেখানোর পর তার নির্দেশনা অনুযায়ী জনস্বার্থে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। এটি যদি আরও আগে করা হতো তাহলে এত বছর এভাবে চলতো না। এই মামলাটি হাইকোর্টে যখন শুনানি হয়েছে, তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দরজা খোলা রেখে যদি সরে যান তাহলে তো চোর চুরি করবেই। যে ঘর পাহারা দেবে সেও যদি চোরের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় তাহলে তো হবে না। এখানে চোরের সঙ্গে অনেকেই একাকার হয়ে গেছেন।’
উল্লেখ্য, চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। নদীভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও স্থানীয়রা বিরোধিতা করলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।
এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙনকবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
ওই চিঠির পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে সম্পৃক্ত নৌযান জব্দ ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ।