‘অসহায় নারীকে প্রভাবশালী রুহুল আমিনের নির্দেশে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার রায় ঘোষণা করা হলো। এ আসামিদের সাজা না হলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে এবং আদালত জনগণের আস্থা হারাবে।’
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণার সময় এমন মন্তব্য করেন জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) ফাতেমা ফেরদৌস।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘সমাজের বিচারব্যবস্থা যাতে ভেঙে না পড়ে এবং আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বজায় রাখতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজা বাঞ্ছনীয়। সুবর্ণচরের এ ঘটনা শুধু একটি পরিবার বা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বরং এটি একটি রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রায়ে কারও মতাদর্শ বিবেচনা করা হয়নি; বরং অপরাধীর অপরাধকে বিবেচনা করা হয়েছে।’
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন ওই এলাকার মৃত খুরশিদ আলমের ছেলে সাবেক ইউপি মেম্বার রুহুল আমিন (৪০), মৃত আব্দুল হাশেমের ছেলে হাসান আলী বুলু (৪৪), মৃত ইসমাঈলের ছেলে মো. সোহেল (৩৫), মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে স্বপন (৩৫), আবুল কাশেমের ছেলে ইব্রাহিম খলিল বেচু (২৫), মৃত ছিড়ু মিয়ার ছেলে আবুল হোসেন আবু (৪০), ফকির আহম্মদের ছেলে মো. সালাউদ্দিন (৩৫), মোতাহের হোসেনের ছেলে জসিম উদ্দিন (৩২), মো. রফিকের ছেলে মো. মুরাদ (২৮) ও মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে জামাল প্রকাশ হেঞ্জু মাঝি (২৮)।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন ইসমাইল প্রকাশ বাগন আলীর ছেলে মো. হানিফ (৩০), আবদুল হামিদের ছেলে মো. চৌধুরী (২৫), মৃত আহম্মদ উল্লাহর ছেলে বাদশা আলম বাসু প্রকাশ কুড়াইল্যা বাসু (৪০), তোফায়েল আহম্মদ তোফার ছেলে মোশারফ (৩৫), আবুল কালামের ছেলে মো. সোহেল (২৮) ও পলাতক মৃত আরব আলী গর্দানের ছেলে মিন্টু প্রকাশ হেলাল (৫৫)।
এদিকে, রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ধর্ষণের শিকার ওই নারী এবং মামলার বাদী তার স্বামী। রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকারের কাছে দাবি জানান তারা।
পাঁচ বছর এক মাস প্রতীক্ষার পর রায় শুনতে স্বামী সন্তানদের নিয়ে আদালতে হাজির হন ভুক্তভোগী নারী। কাঠগড়ার পাশে অপেক্ষায় ছিলেন তারা। দুপুর পৌনে ১টার দিকে রায় ঘোষণা শেষ হলে আদালত থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ওই দম্পতি।
ওই নারী বলেন, ‘আজকের রায়ে আমি খুশি। এলাকাবাসীও খুশি হয়েছে। আদালত যে রায় দিয়েছে সরকার যেন তা দ্রুত কার্যকর করে। আমার ছেলেমেয়ে আছে। আমি আসামি ১৬ জনের ভেতরেই থাকি। চারপাশে আসামি, আমি নিরাপত্তা চাই।’
রায় ঘোষণা শেষে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রাছুল মামুন সাংবাদিকদের জানান, মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন ঘটনাটি কেবল কোনও ব্যক্তির ক্ষতি নয়, এটা রাষ্ট্র এবং মানবতার ক্ষতি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের যদি বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে একই ধরনের অপরাধ সংগঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে এ রায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসামিপক্ষের আইনজীবী হারুনুর রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘মামলার বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত ২৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮ জন ছিলেন সরকারি সাক্ষী। বাকি ১৫ জনের মধ্যে ছয় জন বাদী, ভুক্তভোগী, তাদের ছেলেমেয়ে, মা এবং ভাই। তাদের সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে এ সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে আমরা উচ্চ আদালতে যাবে। আমরা আশাবাদী, উচ্চ আদালতে এ সাজা টিকবে না।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন রাতে উপজেলার মধ্যবাগ্যা গ্রামে চল্লিশোর্ধ্ব ওই নারীর ঘরে ঢুকে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে তাকে দলবেঁধে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। চার সন্তানের ওই জননীর অভিযোগ ছিল, ভোটকেন্দ্রে কয়েক জন ব্যক্তির সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জেরে ওই ঘটনা ঘটানো হয়। সে সময় ওই ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নামে বিভিন্ন সংগঠন।
পরদিন ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে চরজব্বার থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।