পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পার হতে চললেও এখনও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। অস্ত্রের ঝনঝনানি, চাঁদাবাজি, গুম-খুন ও সংঘাত পাহাড়কে অশান্ত করে রেখেছে। চুক্তির পর থেকে গড়ে উঠেছে আরও ছয় ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন। তাদের আধিপত্য বিস্তারের জেরে ঘটেছে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনা।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর অধিকার আদায়ে স্বাধীনতার পরপরই সশস্ত্র সংগঠন (শান্তি বাহিনী) গড়ে তুলেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এটি দিনে দিনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে আড়াই দশক ধরে আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পিসিজেএসএসের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সই করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাহাড়ে শান্তি বাহিনীর তৎপরতা কমে।
ওই শান্তি চুক্তিতে ধারা ছিল ৭২টি। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, এসব ধারা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার অবসান ঘটবে। শান্তি ফিরবে পাহাড়ে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে শান্তি বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে তারা। এখনও তাদের কার্যক্রম পাহাড়ে চলছে আগের মতোই।
পাহাড়ের অনেকের অভিযোগ, সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ২৫টি। আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে ১৮টি ধারা। বাকি ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনারও অবসান ঘটেনি। যার কারণে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে আরও ছয়টি সংগঠন। যদিও পার্বত্য চুক্তির আগে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন বলতে কেবল ছিল শান্তি বাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চুক্তির পর গত ২৭ বছরে গড়ে উঠেছে আরও ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গ্রুপ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টির সশস্ত্র গ্রুপ এবং সর্বশেষ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও তাদের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসব সশস্ত্র গ্রুপের কারণে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম-খুনসহ অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বেড়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যেই ঘটেছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। ২৭ বছরে এসব সশস্ত্র গ্রুপে তৎপরতায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে শতাধিক। অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা নিত্যদিনের।
বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত ও সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর কেবল বান্দরবানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সাত সেনাসদস্যসহ ৫২ জন পাহাড়ি-বাঙালি। অপহরণ ও চাঁদাবাজির মুখে পড়েছেন অর্ধশতাধিক পাহাড়ি-বাঙালি।
এ ছাড়াও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়েও এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মতবিরোধ ও বিরোধিতা। চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এখনও সভা-সমাবেশে ব্যস্ত পাহাড়ি-বাঙালি সংগঠনগুলো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিরসনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি হওয়ার এত বছর পরও পাহাড়ে শান্তি আসেনি। সন্তু লারমা যে চুক্তি করেছেন, তাতে কয়েকটি ধারা এমন আছে যা অসাংবিধানিক। ধারাগুলো বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামে বসবাসরত সব বাঙালিকে ভিটেমাটি ছাড়া হতে হবে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকার এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকার শেষ করে দিয়েছে। বিএনপি বলেছিল ক্ষমতায় গেলে এই চুক্তি বাতিল করবে। কিন্তু করেনি। উল্টো পাহাড়ের ২৪১টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চুক্তির সময় সন্তু লারমা বলেছেন পাহাড়ের সব জনগোষ্ঠীকে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অথচ সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। থামাতে পারেননি সংঘর্ষ। উল্টো তাকে চ্যালেঞ্জ করে ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন তৈরি হয়েছে। তার মানে পাহাড়িরা সন্তু লারমার নেতৃত্ব চায় না। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি সরকার কারও কাছে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আশা করছি, বর্তমান সরকার ন্যায়বিচার করবে। আমরা এখানে শান্তিতে থাকতে চাই।’
তবে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের নেতাদের দাবি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের নামে সময়ক্ষেপণ করেছে। তাই চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনও অকার্যকর। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচন নেই। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইনও অকার্যকর। ফলে আজও স্থায়ী কোনও সমাধান হয়নি।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন বান্দরবান জেলার সহসভাপতি অং চ মং মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বিগত সরকারের কাছে যেভাবে শুনছি, তা হলো চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে জেএসএস বলে আসছিল, চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। আমিও মনে করছি, আসলেই চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করছি, বর্তমান সরকার সব ধারাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।’
২৭ বছরে পার্বত্য চুক্তির মূলধারাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় সশস্ত্র সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে জানালেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (গণতান্ত্রিক) বান্দরবানের সভাপতি উবামং মারমা। তিনি বলেন, ‘শান্তি ফিরিয়ে আনতে পার্বত্য চুক্তির মূলধারাগুলো বাস্তবায়নের কোনও বিকল্প নেই।’
পিসিজেএসএস কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং মারমা বলেন, ‘বর্তমান সরকার চুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বলেই সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।’
তবে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। শান্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন তারা। আরও বলছেন, রাজনৈতিক সরকারগুলো নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ থেকে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে টালবাহানা করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এই সরকারের কাছে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করছেন তারা।