ফরিদপুরের সালথায় তাণ্ডবের ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গত বছরের ৫ এপ্রিল রাতে কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকরের অভিযানকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত জনতা উপজেলা সদরের বিভিন্ন সরকারি দফতরের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন দফতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে প্রায় তিন কোটি টাকার সরকারি সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। নিহত হয়েছেন দুজন।
এ ঘটনায় পুলিশ ও ব্যক্তি উদ্যোগে আটটি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা একটি মামলা ছাড়া অন্যগুলোর তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ফলে এখনও সাত মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়নি পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব মামলা ঘিরে এখনও এলাকাছাড়া সালথা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। এতে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে কয়েকশ পরিবার। যেখানে ঘটনার সূত্রপাত সেই ফুকরা বাজারের সবগুলো দোকানপাট বন্ধ রয়েছে এক বছর ধরে। এতে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। তবে ঘটনার মূলহোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তারা সালথা উপজেলায় ঘোরাফেরা করলেও গ্রেফতার করছে না পুলিশ।
গত বছরের ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় করোনা মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দুই আনসার সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারী নিয়ে সালথা উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা ফুকরা বাজারে যান। অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পেয়ে সালথা থানার এসআই মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে গেলে হামলার শিকার হয়।
পরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। এর জের ধরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সালথা উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সালথা থানার পাশাপাশি ফরিদপুর, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও নগরকান্দা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব গিয়ে ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট-কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। রাত ১২টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট সদস্যসহ ২০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে জুবায়ের হোসেন (২৫) ও মিরান মোল্যা (৩৫) নামে দুই যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পুলিশ জানায়, সহিংসতার ঘটনায় সালথার বিভিন্ন সরকারি ভবন, স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কয়েক হাজার জনকে আসামি করে আটটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি মামলা সালথা থানা পুলিশ ও একটি ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। মামলায় এজাহারনামীয় ৩৮১ এবং সন্দেহভাজন ১৪৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ২২ জন। একজন আটক অবস্থায় মারা যান।
এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা করেছেন সালথা থানার এসআই মো. হান্নান মিয়া। মামলাটি তদন্ত করছেন তিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হান্নান মিয়া বলেন, ‘সালথার সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ বাদী মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেবো।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী এসআই গোলাম মোন্তাছির মারুফ বলেন, ‘ফেসবুকে উসকানিদাতা ও গুজব ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি পুলিশ।’
সালথা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে হামলার ঘটনায় করা মামলার বাদী বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মাতুব্বর বলেন, ‘সহিংসতার ঘটনার মূলহোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা প্রতিদিন সালথা থানা পুলিশের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করে। গ্রেফতারকৃত আসামিরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে যাদের নাম বলেছে, তাদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ। আমি আশা করছি, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনবে পুলিশ।’
ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা-সালথা সার্কেল) সুমিনুর রহমান বলেন, ‘সালথার সহিংসতার ঘটনাগুলো তদন্ত করছে পুলিশ। যাতে কোনও অপরাধী ছাড়া না পায়, একইসঙ্গে কোনও নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে অভিযুক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে তদন্ত অনেকদূর এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর তদন্তকাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে মূল আসামিদের গ্রেফতার না করার অভিযোগ সত্য নয়।’
