X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা

কারাবন্দিদের নকশিকাঁথা ও জামদানিতে মুগ্ধ ক্রেতারা

আরিফ হোসাইন কনক, নারায়ণগঞ্জ
১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:০০আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:০৬

দেশের ৩৮টি কারাগারের বন্দিদের হাতে তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। বন্দিদের পণ্য বিক্রির জন্য ‘কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল’ নামে একটি প্যাভিলিয়ন সাজানো হয়েছে। বাঁশ, বেত, কাঠ, সুতো ও পাট দিয়ে বন্দিদের হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য এই প্যাভিলিয়নে বিক্রি হচ্ছে। তবে বন্দিদের তৈরি নকশিকাঁথা ও জামদানি শাড়ি দেখে মুগ্ধ ক্রেতারা। নজরকাড়া সব ডিজাইনে সবচেয়ে আকৃষ্ট হচ্ছেন তারা। মেলা আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থী একবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারছেন এই প্যাভিলিয়নে। কিনছেন সাধ্যের মধ্যে পছন্দের পণ্যটি।

১ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) চলছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৭তম আসর। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ১০টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের নানা পণ্যে সাজিয়েছে স্টল ও প্যাভিলিয়ন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্যাভিলিয়নের বাইরে ‘কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল’ লেখা দেখে কৌতূহল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। বিশেষ করে জামদানি শাড়ি ও নকশিকাঁথায় দৃষ্টি আটকে যায় সবার। বাঁশ ও বেতের পণ্যতেও দৃষ্টি ছিল কারও কারও। পুঁতি দিয়ে তৈরি নানা সৌন্দর্যবর্ধক পণ্য বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। ঘুরে ঘুরে সব পণ্য দেখেন তারা। এর ফাঁকে কেউ কেউ দরদাম করে কিনছেন পছন্দের পণ্য।  

দেশের ৩৮টি কারাগারের বন্দিদের হাতে তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়

তবে এসব পণ্যের দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে বলে জানালেন উত্তরা থেকে মেলায় আসা সোনিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘কারা পণ্য প্যাভিলিয়নের জামদানি শাড়ি ও নকশিকাঁথাগুলো অনেক সুন্দর। একটি জামদানি শাড়ির দাম আট হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। দাম একটু বেশি মনে হলো। দাম আরেকটু কম হলে ভালো হতো। বেতের চেয়ারের দাম করেছিলাম। সেটির দামও বেশি চাওয়া হয়েছে। তাই কিনতে পারিনি। এজন্য অন্য পণ্য কিনেছি।’ 

নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া থেকে মেলায় এসেছেন রিতা বেগম। তিনি বলেন, ‘এই প্যাভিলিয়নের পণ্যগুলো নজরকাড়া। তবে দাম একটু বেশি। পণ্যগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। এজন্য বেতের কুলা ও চালুনি কিনেছি। মেলার শেষ দিকে দাম কমবে বলে আশা করছি, তখন পছন্দের পণ্য কিনবো।’

কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল প্যাভিলিয়নের দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি জেলার মো. জাকির হাসান রিয়েল। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি, দেশের কারাগারগুলো হবে সংশোধনাগার। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কারা-পরিদর্শকের দিক-নির্দেশনায় কাজ করে যাচ্ছি আমরা। বন্দিদের ৩৮টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই ৩৮টি ট্রেডের আওতায় ৩০০ ধরনের পণ্য তৈরি করে তা দিয়ে বাণিজ্য মেলায় কারা পণ্য প্যাভিলিয়ন সাজানো হয়েছে।’

বন্দিদের তৈরি পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল প্যাভিলিয়ন

পণ্য বিক্রির লভ্যাংশ বন্দিরা পাবেন উল্লেখ করে জাকির হাসান রিয়েল বলেন, ‘এই প্যাভিলিয়নের পণ্য বিক্রি করে যে লভ্যাংশ পাওয়া যায়, তার ৫০ শতাংশ বন্দিদের দেওয়া হয়। বন্দিরা এই অর্থ খরচ করতে পারেন এবং পরিবারের কাছে পাঠাতে পারেন। আমাদের লক্ষ্য হলো বন্দিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশোধন করে সমাজের মূলস্রোতধারায় পুনর্বাসিত করা।’ 

দেশের ৩৮টি কারাগারের পণ্য দিয়ে প্যাভিলিয়ন সাজানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ ও ২, মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, নারায়ণগঞ্জ কারাগার, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার, ফরিদপুর জেলা কারাগার, খুলনা জেলা কারাগারসহ ৩৮টি কারাগারের বন্দিদের হাতে তৈরি নানা পণ্য এখানে তোলা হয়েছে।’ 

প্যাভিলিয়নে থাকা বিভিন্ন পণ্যের বর্ণনা দিয়ে ডেপুটি জেলার বলেন, ‘বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি মোড়া, প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি কুলা, কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকা, পাটজাত পণ্য, জামদানি শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, নকশিকাঁথা, পাটের তৈরি ব্যাগসহ নানা পণ্য রয়েছে প্যাভিলিয়নে। জামদানি শাড়ি চার হাজার থেকে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিংহাসন চেয়ার চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’ 

বাঁশ, বেত, কাঠ, সুতো ও পাট দিয়ে বন্দিদের হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য এই প্যাভিলিয়নে বিক্রি হচ্ছে

পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতাদের অভিযোগের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালে রয়েছে। প্রথমত সব পণ্যের গুণগত মানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। এছাড়া বন্দিদের আবেগের জায়গা রয়েছে। তাদের বুনন কৌশলের মধ্য দিয়ে মননশীল চিন্তাভাবনা ফুটে উঠেছে। এসব দিক বিবেচনা করে পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখা হয়েছে।’ 

মেলায় বেশ সাড়া পাচ্ছি উল্লেখ করে জাকির হাসান বলেন, ‘গত বছর বাণিজ্য মেলায় সাধারণ প্যাভিলিয়নে আমরা তৃতীয় হয়েছি। এর আগের বছর সংরক্ষিত মিনি প্যাভিলিয়নে আমরা প্রথম হয়েছিলাম। এ বছর প্রত্যাশা করছি, আগের তুলনায় ভালো হবে। ক্রেতা বেড়েছে, বেচাকেনাও ভালো।’

প্যাভিলিয়নে পণ্য বেচাকেনাসহ সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় (কেরানীগঞ্জ) কারাগারের কারারক্ষী হাসান মাহমুদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্দিরা যেসব পণ্য তৈরি করেছেন সেসব দিয়ে প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছি আমরা। ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর বাণিজ্য মেলায় এসব পণ্য তোলা হয়। এবার বেচাকেনা বেশ ভালো।’ 

কোন কারাগার থেকে কী ধরনের পণ্য তোলা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কারাগারের বন্দি নারী-পুরুষের হাতে তৈরি নানা পণ্য এখানে তোলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে তৈরি জামদানি শাড়ি, নারায়ণগঞ্জ কারাগারের তৈরি শীতের কটি, কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে তৈরি নকশিকাঁথা রয়েছে এখানে। এছাড়া বেতের তৈরি চেয়ার, পাট দিয়ে তৈরি শিশুদের দোলনা, সিংহাসন চেয়ার, কাঠ-বাঁশ দিয়ে তৈরি একতারা, ডুগডুগিসহ ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য বন্দিরা তৈরি করেছেন। কাঠের তৈরি রুটি মেকার, বাঁশ দিয়ে তৈরি চালুনি ও কুলাসহ নানা পণ্য ভালো বিক্রি হচ্ছে।’ 

বন্দিদের তৈরি নকশি কাঁথা ও জামদানি শাড়ি দেখে মুগ্ধ ক্রেতারা

মেলার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সচিব ও বাণিজ্য মেলার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেলা জমে উঠেছে। গতকাল শুক্রবার দেড় লাখের বেশি লোকের সমাগম হয়েছে। এটি দুই লাখ ছড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। ১৫ জানুয়ারির পর মেলা আরও জমবে।’

মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকটি চুরি ও পকেট মারের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে আমরা যথাসময়ে তাদের আইনের আওতায় এনেছি। এ বিষয়ে আমাদের টিম কাজ করছে।’

মেলায় দেশি-বিদেশি ৩৩১ প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে জানিয়ে ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এর মধ্যে কয়েকটি প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার ১০৬টি স্টল বেড়েছে। ১০টি দেশের ১৭টি স্টল রয়েছে। এবার বড় পরিসরে মেলার আয়োজন করা হয়েছে।’

কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল প্যাভিলিয়নে ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড়

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলায় খাদ্যপণ্যের মান এবং মূল্যের বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন আয়োজকরা। খাদ্যপণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট থাকবে। মেলায় যাতায়াতে যাতে কোনও ধরনের নিরাপত্তার ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। মেলায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য গতবারের মতো বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মেলা প্রাঙ্গণ পর্যন্ত ৭০টি বিআরটিসি বাস চলাচল করছে। এসব বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ টাকা। মেলা চলবে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। তবে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত মেলা চলবে।

এবার মেলায় প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৪০ টাকা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা। মেলার টিকিট অনলাইনে কিনলে ৫০ শতাংশ ছাড় আছে। মেলায় প্রায় এক হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে।

/এএম/
সম্পর্কিত
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দির মৃত্যু
অপহরণ মামলায় জেল, কারাগারে বসে ফের অপহরণের পরিকল্পনা
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা