রফিুকল ইসলাম (৮০)। চেহারায় বয়সের ভাঁজ। শান্তিনিবাসে ঈদের দিন কাটছে তার। চাকরি করতেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা। পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কেটেছে তার। সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থাও করেছেন, দিয়েছেন বিয়ে। কিন্তু তখনও কঠিন জীবনের কথা জানতেন না। হঠাৎ তার স্ত্রী মারা যান। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সন্তানদের অত্যাচারে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে হয় তাকে। এরপর ভবঘুরে রফিকুলের ঠাঁই হয় ফরিদপুরের শান্তিনিবাসে। আগের মতো আর সন্তানদের হাতে হাত রেখে যেতে পারেন না ঈদের কেনাকাটা করতে। বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের মাঝে মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলেন চোখের পানি।
শনিবার (২২ এপ্রিল) ঈদের দিন সকালে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা এলাকায় অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত শান্তিনিবাসে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। ছেলে ও তার বউরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকি। এক পর্যায়ে জামালপুরের সমাজসেবার কর্মকর্তারা দুই মাস আগে আমাকে ফরিদপুর শান্তিনিবাসে পাঠিয়ে দেন। এখানেই আছি, ভালো আছি।’
এই প্রথমবার পরিবার ছাড়া ঈদ কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আর কথা বলতে পারেননি। শুধু একটি কথাই বলেন, ‘আমার মতো সন্তান যেন আর কারও না হয়।’
শুধু রফিকুল ইসলাম নয় সমাজসেবা পরিচালিত শান্তিনিবাসে পরিবারহীন বাবা-মায়ের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে ১০ জন নারী ও পাঁচ জন পুরুষ।
তাদের সবারই ঈদ কাটছে পরিবারহীন, যাদের অনেককে কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে। বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলছেন চোখের অশ্রু। তাদের অতীতের সুখ গল্পগুলো আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করছেন এই অসহায় বাবা-মা। যাদের জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন সন্তানের জন্য। সেই সন্তানদের ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা।
এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন হাসনা বেগমও (৬০)। তিনি জানান, এখানে রয়েছেন চার বছর। স্বামী মারা গেছে ১৫ বছর আগে। একটি মাত্র মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে তার সম্পত্তি যা ছিল লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এরপর ঠাঁই হয় শান্তিনিবাসে। তার কোনও খবর নেয় না মেয়ে।
তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দ করার কথা ছিল আমার। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। এই বৃদ্ধাশ্রমেই কাটছে ঈদ। এখানকার মানুষজন অনেক ভালো। এখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও দেওয়া হয়। ঈদের দিন ভালো পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়েছে। মনে কষ্ট নিয়েও এখানে ভালো আছি।’
বৃদ্ধ বয়সে একা জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের। সন্তানদের জন্য বাবা-মায়ের বুক ফেটে গেলেও পাচ্ছেন না তাদের ছোঁয়া। এই বাবা-মায়ের ঈদের আনন্দটাই যেন তাদের সন্তানবিহীন বৃদ্ধাশ্রমকে ঘিরে।
ঈদের দিন সকালে তাদের দেওয়া হয়েছে উন্নতমানের খাবার। সকালে খিচুড়ি, সেমাই ও ডিম। দুপুরে পোলাও, গরুর মাংস, রোস্ট ও মিষ্টি। রাতেও রয়েছে উন্নতমানের খাবার। দেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক।
শফিক হোসেন বলেন, ‘সরকারি চাকরি করতাম। ভালোই চলছিল। হঠাৎ স্ত্রী মারা যায়। এরপর ছেলেমেয়েরা চাপ দেয় আবার বিয়ে করার জন্য। তাদের চাপে বিয়ে করি। দ্বিতীয় স্ত্রীরও সন্তান হয়। তখন ছেলেমেয়েদের চাপে আমার সব সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দিতে হয়। এরপর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমার ঠাঁই হয় শান্তিনিবাসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাঝে মধ্যে মেয়ে কল দেয়, নাতিরা কথা বলে। সকালেও কল দিয়েছিল। ওদের কাছে থাকলে যে যন্ত্রনা সহ্য করা লাগতো, তার থেকে এখানে ভালো আছি। আমাকে অনেক যত্ন করে এখানে যারা দায়িত্বে আছে। অসুস্থ তাই ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারিনি। ঈদের আগের দিন নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে, ঈদের দিন ভালো খাবার দিয়েছে। ওষুধও এখান থেকে দেয়। ভালো আছি।’
শান্তিনিবাসে বসবাসকারীদের সেবায় নিয়োজিত জাহেদা খানম বলেন, ‘এখানে যারা আছেন তাদের সঙ্গে মা-বাবার মতো আচরণ করি। এখানে অনেকেই অসুস্থ। তাদের গোসল করানো এমনকি খাইয়েও দিতে হয়। ঈদের দিন তাদের নতুন পোশাক ও উন্নতমানের খাবার দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবাই বৃদ্ধ তাই তাদের যত্ন না নিলে একলা কিছুই করতে পারেন না। চাকরির জন্য নয়, দায়িত্ববোধ থেকেই এসব করি।’
