কালাচারাল অফিসারের অসহযোগিতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অনুপস্থিতির কারণে কিশোরগঞ্জের শিল্পকলা একাডেমির কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে সেখানে অনুষ্ঠানাদি করতে পারছে না সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। অনেকটা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন খোলা জায়গা, রাস্তাঘাটে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, জেলা কালচারাল অফিসার তানিয়া ইসলাম ঝুমুর সাংস্কৃতিক কাজের চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এ কারণে পারতপক্ষে তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে অনুষ্ঠানের জন্য শিল্পকলার অডিটোরিয়াম বরাদ্দ দিতে চাইতেন না। নিয়মিত সেখানে আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের অনুষ্ঠান হতো। অনেক সময় দেখা গেছে, কোনও একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে অডিটোরিয়াম বরাদ্দ দিয়ে পর কারণ ছাড়াই বাতিল করেছেন। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ড কাগজপত্রে দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসক ও উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে নিয়েছেন।
এই কালচালার অফিসারের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে দুটি স্মারকলিপি আছে। একটি তাকে বদলির জন্য আরেকটি তাকে এই পদে রাখার জন্য। অভিযোগ আছে, তিনি জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে এই পদে রাখার পক্ষে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
অনেকের অভিযোগ, কোনও বিষয়ে আপত্তি বা প্রতিবাদ করলে তাকে ভয় দেখানো হতো। বাড়াবাড়ি করলে শিল্পকলার ত্রি-সীমানায় প্রবেশ করতে দেবেন না বলে হুমকি দেওয়া হতো। এ কারণে সংস্কৃতিকর্মীরা তাকে তার বিরুদ্ধে যেতে সাহস করতেন না। পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকে।
সংস্কৃতিকর্মী ইফতেখার হোসেন সাকিব জানান, কালচারাল অফিসার তানিয়া ইসলাম ঝুমুরের যোগদানের পর থেকে জেলা শিল্পকলায় শিল্পীদের আনাগোনা কমে যায়। শিল্পকলার বারান্দাতেও শিল্পীরা রিহার্সাল করতে পারে না। এর জন্যও ভাড়া দাবি করা হয়। ১৫ দিন আগে হল বুকিং দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানের কারণে বুকিং বাতিল করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বেশ কয়েকবার করেছেন তিনি।
বেশ কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মীর অভিযোগ, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো অনুষ্ঠানের জন্য অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়েও টাকা পরিশোধ করতো না। আর সংস্কৃতি সংগঠনগুলোকে সুবিধা কম দিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করতেন এই কর্মকর্তা। কোনও ছাড় তার কাছ থেকে পাওয়া যেতো না।
ফলে জেলার সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। অভিযুক্ত কালচারাল অফিসারের বদলিসহ বিভাগীয় শাস্তি দাবি করছেন তারা। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে দুই দফা লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে।
এ কর্মকর্তার শাস্তি দাবিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিক্ষোভ করেন শতাধিক সংস্কৃতিকর্মী। পরের দিন তখনকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ শিল্পকলায় একাডেমিতে গিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। এরপর থেকে জেলা কালাচারাল অফিসার শিল্পকলা একাডেমিতে যাননি। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন অঙ্গনের ৩৩ শিল্পীর কাছ থেকে কৌশলে ওই কালাচারাল অফিসার সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন। সেই কাগজে তার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। ওই স্মারকলিপি তিনি তিনি সম্প্রতি যোগদান করা জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিয়েছেন।
একতা নাট্যগোষ্ঠী অধিকর্তা ও শিল্পকলা একাডেমির নৃত্য প্রশিক্ষক মানস কর বলেন, আমার কিছু করার ছিল না। আমি এখানে চাকরি করি, আমার কাছে কাগজ পাঠানো হয়েছে স্বাক্ষর করার জন্য। আমি বারবার বলেছি, লেখাটা দেখানোর জন্য- আমাকে দেখানো হয়নি। শুধু একটা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
নজরুল সংগীত একাডেমির সভাপতি আবুল হাসেমের কাছে স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি।
সামাজিক সংগঠন আরডিএসের পরিচালক আদনান আবিদ বলেন, আমরা কয়েকদিন আগে বন্যার্তদের জন্য তহবিল গঠনে একটি অনুষ্ঠানের জন্য শিল্পকলার হল বরাদ্দ চেয়েছিলাম। তিনি এসি, সাউন্ড সিস্টেম নষ্টসহ নানান অজুহাত দেখিয়ে বরাদ্দ দেননি। পরে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে হল বরাদ্দ পাই। তখন দেখা গেলো, সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। অনুষ্ঠান করতে কোনও সমস্যা হয়নি। সবসময় তিনি সংস্কৃতিকর্মীদের এভাবেই হতাশ ও হয়রানি করেন। এটাই তার স্বভাব। কাজেই তিনি এখানে থাকলে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা বেগবান হবে না।
সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি, দ্রুত শিল্পকলা একাডেমির নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের শিল্পকলার দায়িত্ব দিতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে সংস্কৃতিচর্চা হয় না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে তানিয়া ইসলাম ঝুমুরের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। তার মোবাইল নম্বরে মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সঙ্গে বুধবার দুপুরে কথা হলে তিনি বলেন, শিল্পকলার বিষয়ে আমার কাছে দুটি স্মারকলিপি রয়েছে। একটি কালচারাল অফিসারের বিরুদ্ধে, আরেকটি পক্ষে। আমি পুরো বিষয়ে দ্রুত তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছি। তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে শিল্পকলাকে সংস্কৃতিবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।