১৩ বছর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে তৈরি হওয়া ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে আবার একীভূত করে একটি একক মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। গত ২০ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সংস্কার কমিশনের ভাষ্যে মতে, বিভক্ত সিটি করপোরেশন কাঠামোতে কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর এই বিভাজন ঢাকার প্রশাসনিক জটিলতা, দায়িত্বের দ্বন্দ্ব ও সেবা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তুলেছে। লন্ডনের নগর সরকার কাঠামোর আদলে ‘মহানগর সরকার’ গঠন করলে এই সমস্যা নিরসন পাবে। এক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে একক মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ঢাকাকে একীভূত করে একটি একক সিটি করপোরেশন গঠনের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক ‘সিটি কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আওতায় থাকা ২০টি অঞ্চলকে স্বতন্ত্র ২০টি সিটি কাউন্সিল গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিটি সিটি কাউন্সিল গঠিত হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ডগুলো নিয়ে।
এতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি কাউন্সিলে ৯ থেকে ১৫টি ওয়ার্ড থাকবে, যা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। এসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নির্বাচিত হবেন সরাসরি জনগণের ভোটে। তবে সিটি কাউন্সিল এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হবেন পরোক্ষভাবে কাউন্সিলরদের ভোটে।
সংস্কার কমিশনের মতে, এই পদ্ধতি সেবা প্রদানে তৃণমূল অংশগ্রহণ, দায়বদ্ধতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করবে। কেন্দ্রীয় করপোরেশন থাকবে একটি সমন্বয়কারী ও নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
সিটি কাউন্সিলের কাজ কী হবে!
সংস্কার কমিশনের ঢাকার দুই সিটিকে একীভূতকরণের যে রোডম্যাপ তাতে সিটি কাউন্সিলের গুরুত্ব ব্যাপক। কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া সিটি কাউন্সিল জননিরাপত্তা (কমিউনিটি পুলিশ) এবং অগ্নিনির্বাপণ পরিষেবা, মশকনিধন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ফুটপাত, রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে।
এছাড়াও ব্যবসায় বা পেশার নিবন্ধন বা অনুমোদনসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সরাসরি প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে সিটি কাউন্সিল। একইসাথে স্থানীয় করও সংগ্রহ করবে সিটি কাউন্সিল।
'ঢাকা মহানগর সরকারে’ অঞ্চলভিত্তিক যে সিটি কাউন্সিল গঠন করার কথা উল্লেখ করেছে তার সম্ভাব্য একটি তালিকাও করে দিয়েছে কমিশন। যেমন বনানী, বারিধারা, গুলশান নিয়ে হবে একটি কাউন্সিল। উত্তরা পূর্ব-পশ্চিম নিয়ে একটি, দক্ষিণ খান ও উত্তরখান নিয়ে একটি এবং মিরপুর, পল্লবী, মোহাম্মদপুর আলাদা আলাদা সিটি কাউন্সিল হবে।
এছাড়াও ধানমন্ডি-রায়েরবাজার নিয়ে একটি, লালবাগ, কেরানীগঞ্জ, রামপুরা-বনশ্রী-খিলগাঁও-মালিবাগ-মুগদা-বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ, রমনা-মতিঝিল-দিলকুশা, বসুন্ধরা-ভাটারা, কাফরুল-ক্যান্টনমেন্ট, আরামবাগ-বাংলাবাজার-ওয়ারী-সূত্রাপুর-কোতোয়ালি, খিলক্ষেত–কুড়িল, গাবতলী-আমিনবাজার, সাঁতারকুল, ডেমরা ও তেজগাঁও-আগারগাঁও-সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে সিটি কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুই সিটিকে একীভূতকরণের বিষয়ে কী ভাবছে সাধারণ জনগণ!
সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আট সদস্যের এই টিম বলেছে, বিগত সময়ে কাঠামোগত জটিলতা, সমন্বয়হীনতা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়েছে। তাই পুনরায় একীভূত করে অঞ্চলভিত্তিক কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দেওয়াই সমাধান হতে পারে।
এই কমিশনের নেতৃত্বে থাকা ৮ সদস্যের টিম আরও বলছে, দুই সিটি একীভূতকরণের কাঠামো তৈরি হলে যেমন দায়িত্ব ভাগ হবে, তেমনি নিরীক্ষা ও জবাবদিহি সহজতর হবে। নাগরিকদের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে নির্দিষ্ট এলাকায় স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ইউনিট থাকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত হবে।
এদিকে সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাব নিয়ে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের মাঝে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ মনে করছেন, দুই সিটির দায়িত্বশীলদের সমন্বয়হীনতায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে, আবার কেউ বলছেন কাঠামো বদল না করে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।
বাড্ডার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, বিগত সময়ে দুই মেয়রের সমন্বয়ের অভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অনেক সময় রাস্তা খোঁড়া হয় এক মেয়রের আওতায়, কিন্তু মেরামত হয় না অন্যজনের দায় না নেওয়ায়। এছাড়াও কোনও এলাকায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে থাকলে এক সিটি করপোরেশনের অন্য সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করে। এক হলে হয়তো সমন্বয় বাড়বে, তবে এর অনেক অসুবিধাও হবে।
এই বাসিন্দা আরও বলেন, বলা চলে ১৩ বছর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তের অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এর ফলে দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় আলাদা আলাদা উন্নতি হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার চোখে উত্তর সিটি করপোরেশন একটু বেশি এগিয়ে থাকবে। কারণ দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে কাজ কিছুটা বেশি হয়েছে। তাছাড়া উত্তরে অনেক বেশি ভিআইপি এলাকা রয়েছে।
কাজলার বাসিন্দা মো. আলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পত্রপত্রিকার মারফতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে উত্তর সিটি করপোরেশনের তুলনায় দক্ষিণ সিটি অবহেলিত ছিল। দক্ষিণ সিটিতে অল্প বৃষ্টিতেই সড়ক ডুবে যায়। বর্ষাকালে দক্ষিণ সিটির বাসিন্দাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। এখন দুই সিটিকে একীভূত করলে যদি একই সাথে উন্নয়ন সাধিত হয় সেক্ষেত্রে এটা পজিটিভ।
দক্ষিণ সিটির সূত্রাপুরের বাসিন্দা সুরাইয়া আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিটি করপোরেশন হোক আর না হোক মশা তো মরছে না, রাস্তাঘাট ও ঠিক হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছা না থাকলে একীভূতকরণে কিছু হবে না। মানুষ চায় দুর্ভোগ মুক্ত সিটি, সঠিক সেবা।
কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হলে জনগণের ভোটাধিকার খর্ব হবে
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মতে যদি কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয় তাহলে সরাসরি মেয়র নির্বাচনের অধিকার হারাবে সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। এক্ষেত্রে মেয়রের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাজী মোতালেব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের ভোটে এখন মেয়র নির্বাচিত হয়। যার কারণে ভোট চাইতে হলেও মেয়রকে আমাদের কাছে আসতে হয়। মেয়র যদি আমাদের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে কাউন্সিলরের ভোটে নির্বাচিত হয় তাহলে মেয়রের দম্ভ-অহংকার বেড়ে যাবে। মেয়র আর জনগণকে মূল্যায়ন করবে না। জনগণের সঙ্গে মেয়রের দূরত্ব বাড়বে।
এই বাসিন্দা আরও বলেন, জবাবদিহির জায়গা বাড়ানো উচিত। সংস্কার কমিশনের বরং দুর্নীতি প্রতিরোধে কী কী করণীয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা উচিত ছিল। জনগণকে বাদ দিয়ে কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র নির্বাচনের যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন দিয়েছে তা একেবারেই অযৌক্তিক।
উত্তর সিটি করপোরেশন সাঁতারকুলের বাসিন্দা কামাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দায়বদ্ধতার খাতিরে হলেও বিগত সময়ে মেয়ররা অনেকবারই রাস্তায় এসে কাজ করেছে। জনগণের সাথে মিশেছে, জনগণের ভোগান্তি লাঘবের চেষ্টা করেছে। কিন্তু যখন মেয়র জনগণের ভোট ছাড়া শুধু কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হবে তখন কিন্তু জনগণের প্রতি মেয়রের দায়বদ্ধতা কমে যাবে। তখন মেয়রের খেয়াল থাকবে যে আমার জনগণ লাগবে না কাউন্সিলর হলেই চলবে।
এদিকে নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সমস্যা কাঠামোগত নয় বরং প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির সংস্কৃতি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে কঠিন করে তুলেছে এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে একীভূতকরণ কোনও সমাধান নয় বরং দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও জনমুখী প্রশাসন প্রয়োজন। একাধিক সিটি থাকলে দায়িত্ব বণ্টনও সহজ হয়।
সংস্কার কমিশনের দুই সিটিকে একীভূতকরণের যৌক্তিকতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় দুটি সিটি করপোরেশন নাগরিক সেবা নিশ্চিতের দিক থেকে যুক্তিযুক্ত। তবে সিটি করপোরেশনগুলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর আইনি কাঠামো থাকা জরুরি। তাছাড়া বর্তমানে সরাসরি জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কাউন্সিলরদের ভোটে যদি মেয়র নির্বাচিত হয় তবে তা জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার খর্ব করবে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থি।
উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন নগরী ঢাকাকে পৌরসভা করা হয় ১৮৬৪ সালে। এরপর নানা পরিক্রমায় ১৯৯০ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নামকরণ করা হয়। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশন যাত্রা শুরু করে।