X
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
৯ আষাঢ় ১৪৩২

৫ আগস্টের পর ক্ষমতার বিরোধে দুই বন্ধু হয়ে গেলেন শত্রু, ঘটে গেলো জোড়া খুন

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
২৩ জুন ২০২৫, ১০:৪১আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ১০:৪১

নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অটোস্ট্যান্ড দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব ও হামলায় পরপর দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মেহেদী হাসান (৩৮) প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তবে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে তার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন তার এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা রনি। সেই দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করা হয়। অপরদিকে এই দ্বন্দ্বের জেরে রনি গ্রুপের সদস্য পারভেজের ওপর আক্রোশ থেকে তার বাবা ও রাজমিস্ত্রি আবদুল কুদ্দুসকে (৬০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

রবিবার (২২ জুন) বিকালে সরেজমিনে বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ ও হাফেজীবাগ এলাকা ঘুরে এমন নানা তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, টানা দুই দিন ধরে বিএনপির দুই পক্ষের হামলা, সংঘর্ষ ও দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো এলাকা থমথমে। অনেক দোকান-পাট বন্ধ। তবে কয়েকটি দোকান খুললেও দোকানিরা আছেন ভয়ে-আতঙ্কে। পুরো এলাকাজুড়ে পুলিশের টহল। অন্যদিকে নিহতদের দুই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। 

বন্দরের হাফেজীবাগ এলাকায় নিহত আব্দুল কুদ্দুসের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার মেয়ের জামাতা মিনার হোসেন বলেন, কুদ্দুস পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তার সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ ছিল না। তবে তার ছেলে পারভেজ এলাকার লোকজনের সমস্যা হলে প্রতিবাদ করতে যেত। এতে পারভেজের সঙ্গে এলাকার কারও কারও সঙ্গে বিরোধ তৈরি হতে পারে। কিন্তু হয়তো পারভেজকে না পেয়ে প্রতিশোধ নিতে সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের নির্দেশে বাবু ও তার গ্রুপের লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। রাতে কবুতরের খাবার কিনতে গেলে এ ঘটনা ঘটে।

অপরদিকে নিহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী হাসানের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। নিহতের মা নাজমা বেগম ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমার ছেলে কোনও অপরাধ করেনি। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।

নিহত মেহেদী হাসানের বড় ভাই খালিদ হাসান বলেন, রেললাইন এলাকার রনি, জাফর, রায়হান গ্রুপ এলাকায় ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। কিছুদিন আগে পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনের সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। এ ঘটনায় মেহেদী তাদের বিচার করে দিয়েছে। এরপরও তারা প্রতিপক্ষের লোকজনকে কুপিয়ে আহত করেছে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। শনিবার (২১ জুন) কোনও একটি ইস্যুতে এলাকায় ফের ঝামেলা শুরু হয়। এর মধ্যে কে বা কারা কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে। এই ব্যক্তি ভালো মানুষ ছিল। মূলত তার ছেলে পারভেজ ওই গ্রুপের (রনি-জাফর) সঙ্গে জড়িত। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় আমি আমার ভাইকে বাড়ির বাইরে যেতে দেইনি। আমি তাকে ধমক দিয়ে বাড়ির ভেতরে অবস্থান করতে বলি।

তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেহেদী বন্দর বাজার হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ক্লাবের সামনে দিয়ে তার নেতা আবুল কাউসার আশার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। এ সময় রনি-জাফর গ্রুপের ৫০-৬০ জন লোক তাকে মারধর করে। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়।

তিনি আরও বলেন, আমার ভাই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সে আবুল কাউসার আশার অধীনে রাজনীতি করে আসছে। বিএনপির রাজনীতির সুবাদে স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপি নেতা হান্নান সরকারের সঙ্গেও রাজনীতি করেছে।

এ বিষয়ে বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মোশাররফ হোসেন বলেন, নিহত মেহেদী হাসান এক সময় নারায়ণগঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরে বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ছিল। সে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তবে বর্তমানে কোনও পদে নেই।

তিনি আরও বলেন, রনি ও মেহেদী হাসান একসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতি করতো। তারা আবুল কাউসার আশা ও হান্নান সরকারের রাজনীতি করতো। তাদের চলাফেরা ছিল একসঙ্গে। তবে সম্প্রতি রনি মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং। এদিকে কোনও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে। সেই বিরোধ থেকে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ঝগড়া বিবাদ হয়েছে। তবে মেহেদী হাসানকে রনি মেরেছে কি না তা এখনও নিশ্চিত নই। যদিও স্থানীয়রা অনেকে বলছেন, রনি গ্রুপের লোকজন মেহেদীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এই পুরো বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশ বের করবে।

স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হত্যার ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে বিশৃঙ্খলা ও ঝগড়া-বিবাদে জড়িত না হওয়ার জন্য। এখন উভয় পক্ষ ঝগড়া-বিবাদ করলে দল থেকে কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা নেই। তাছাড়া মেহেদী হাসান ও রনি এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে নেই। ফলে এ বিষয়ে আপাতত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা নেই।

স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় রনি ও মেহেদী হাসানের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তবে গত ৫ আগস্টের পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য নিতে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর থেকে তাদের মধ্যে বিরোধ দৃশ্যমান হয়, যা এক পর্যায়ে হামলা ও সংঘর্ষে রূপ নেয়। এর ফলশ্রুতিতে হামলা, মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে বন্দর থানার ওসি লিয়াকত আলী বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে কুদ্দুস ও মেহেদী নিহত হয়েছেন। উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এ ঘটনায় পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদী বলেন, হান্নান গ্রুপের লোকজন রনি গ্রুপের একজন সমর্থককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। পরে এলাকার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে রনি গ্রুপের লোকজন উত্তেজিত হয়ে হান্নান গ্রুপের একজনকে মারধর করে হত্যা করে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এর আগে, বন্দর উপজেলার দুটি এলাকায় দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে একই রাতে মেহেদী হাসান (৩৮) ও আবদুল কুদ্দুস (৬০) নামে দুজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা পুরো এলাকা জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিহত আব্দুল কুদ্দুস বন্দরের হাফেজীবাগ এলাকার মৃত সাদেক আলীর ছেলে ও রনি-জাফর গ্রুপের সমর্থক। অপর নিহত মেহেদী হাসান শাহী মসজিদ এলাকার জলিল মুন্সির ছেলে ও বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি বাবু-মেহেদী গ্রুপের সদস্য ছিলেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দর রেললাইন অটোস্ট্যান্ড ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাওসার আশার অনুসারী রনি-জাফর গ্রুপের সঙ্গে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির নেতা হান্নান সরকারের অনুসারী বাবু-মেহেদীর বিরোধ চলছে। এ নিয়ে গত শুক্রবার দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৮ জন আহত হন।

সেই বিরোধের জের ধরে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাবু-মেহেদী গ্রুপের লোকজন রনি-জাফর গ্রুপের সমর্থক আব্দুল কুদ্দুসকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই খবর পেয়ে নিহতের স্বজন ও রনি-জাফর গ্রুপের লোকজন রেললাইন সংলগ্ন এলাকার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। 

এদিকে, রাত ১টার দিকে বন্দর সিরাজুদ্দৌলার ক্লাব মাঠ দিয়ে মেহেদী ও তার লোকজন যাওয়ার পথে তাদেরকে দেখে রনি-জাফর গ্রুপের লোকজন ধাওয়া দিয়ে মেহেদীকে ধরে পিটুনি দেয় ও ছুরিকাঘাত করে। পরে স্থানীয়রা তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শহরের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

/এফআর/
সম্পর্কিত
নূরুল হুদাকে আটকের সময় মব, আইনশৃঙ্খলার কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা: উপদেষ্টা
স্ত্রীর লাথিতে স্বামী নিহত, শিশুসন্তানসহ কারাগারে নারী
দৌলতদিয়ায় দুই মামলার আসামিকে কুপিয়ে হত্যা
সর্বশেষ খবর
দেশব্যাপী স্কাউটস কাব কার্নিভালের উদ্বোধন প্রধান উপদেষ্টার
দেশব্যাপী স্কাউটস কাব কার্নিভালের উদ্বোধন প্রধান উপদেষ্টার
আজও অবস্থান কর্মসূচিতে এনটিআরসিএ’র সনদ প্রত্যাশীরা
আজও অবস্থান কর্মসূচিতে এনটিআরসিএ’র সনদ প্রত্যাশীরা
সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ, ৪ জনকে আটক
সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ, ৪ জনকে আটক
ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায় মন্দা, নেপথ্যের কারণ কী
ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায় মন্দা, নেপথ্যের কারণ কী
সর্বাধিক পঠিত
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক