গাছের গুঁড়ি, ডাল দিয়ে চামচ, হামানদিস্তা, বাটি, খুন্তি, চরকা (ডাল ঘুঁটার জন্যে), ওড়ং, ধামা, গ্লাস, ফুলদানি, চুড়ির আলনা, খেলনা ডিম, আপেলসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করছেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার তিন গ্রামের মানুষ। এ কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন ওই তিন গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। ওই এলাকা এখন ‘কুটিরশিল্পের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে কাজ। দিনে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তারা। তবে কেশবপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম আবু আনাস মোহাম্মদ নাসের একথা অস্বীকার করেছেন।
কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল, মঙ্গলকোট ও কন্দপপুর এলাকায় গাছের গুঁড়ি ও ডাল থেকে তৈরি হয় ২০-২৫ রকমের তৈজসপত্র। এই তিনটি গ্রামে ছোট-বড় ৫০টি কারখানা রয়েছে। প্রায় ৫০০ বাড়িতে রয়েছে এমন কারখানা। প্রতিটি কারখানায় ১০-২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বাড়িতেও পরিবারের সদস্যরা এসব তৈজসপত্র তৈরি করে থাকেন।
কারখানা মালিক ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর ৩০ আগে ভারত থেকে বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির কলাকৌশল শিখে আসেন আলতাপোল এলাকার ইনসার শেখ। প্রথম দিকে তিনি বাঁশ দিয়ে এসব জিনিসপত্র তৈরি করে সেগুলো বাজারজাত করতেন। তার দেখাদেখি এলাকার আরও কয়েকজন তা শুরু করেন। পরে বাঁশের জোগান কম হওয়ায় তারা কাঠ ও ডাল দিয়ে এসব মালামাল তৈরি করেন।
ইনসার শেখের ছোট ছেলে বখতিয়ার শেখ। তিনি কেশবপুর ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্সের ছাত্র (ফাইনাল ইয়ার)।
বাড়িতে বসে তিনিও এই কাজ করছিলেন। বখতিয়ার বলেন, ‘আমার বাবাই এই অঞ্চলে প্রথম এই শিল্পকর্মটি আনেন। এরপর তা বিস্তৃতি লাভ করে।’ বর্তমানে তিনি ও তার মা সকিনা বেগম এই কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন।
তার মতে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিকমতো পেলে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজ করলে ভালো উপার্জন করা যায়। পড়াশুনার ফাঁকে যতটুকু সময় পাচ্ছেন, তারই সদ্ব্যবহার করছেন তিনি।
কুটিরশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় আমজাদ আলী সরদার ও ফাতেমা বেগম দম্পতি। তাদের তিন সন্তান আল আমিন, আলিমুন হাসান ও আরিফুল ইসলাম। তারাও এই কাজ করে। আল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে (তৃতীয় বর্ষ) পড়াশুনা করছেন। প্রাইমারি পাস বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার।
ফাতেমা বলেন, ‘বছর ১৫ আগে তারা এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এর আগে তার স্বামী মাঠে কৃষিকাজ করতেন। সংসার কোনোমতে চলতো। এখন খাওয়া-পরার সমস্যা তেমন নেই। বছর তিন আগে ৫ কাঠা মাঠের জমিও কিনেছেন। কিন্তু ছেলের জন্য ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারেন না। অপর দুই সন্তান সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
ওজিয়ার রহমান নামের এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘দিনের বেলা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ পাই। ঠিকমতো পেলে ব্যবসা খুব ভালো হতো। শ্রমিকরাও তাদের কাজ অনুযায়ী বেশি মজুরি পেতো।’ তার দাবি, দিনে কমপক্ষে আট ঘণ্টা যেন বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক থাকে।
এই এলাকার সবচেয়ে বড় কারখানার মালিক কবির হোসেন। তিনি বলেন, এই কুটিরশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে আরও কিছু পেশার মানুষ। যেমন, স-মিল, ভুসি বিক্রেতা, ভ্যান-পিকআপ চালক প্রভৃতি। এ অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে মালামাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। বিদ্যুতের অসহ্য লোডশেডিংয়ের কারণে আমরা চাহিদা মতো পাইকারদের সরবরাহ করতে পারছি না। আর যারা শ্রমিক, তারাও তাদের কাঙ্ক্ষিত মজুরি পাচ্ছেন না। মোদ্দা কথা, বিদ্যুৎ সরবরাহ যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে আমাদের সবার জন্য উপকার হয়।’
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ (কেশবপুর)-এর ডিজিএম আবু আনাস মোহাম্মদ নাসের বলেন, ‘পিক আওয়ারে আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদা ১২ থেকে সাড়ে ১২ মেগাওয়াট। অফপিক আওয়ারে ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, ‘চাহিদার সর্বাংশই আমরা পাই, কোনও ঘাটতি নেই। রোজার প্রথম দিকে ঝড়ের কারণে কিছু সমস্যা ছিল। তাছাড়া অভয়নগর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, সেক্ষেত্রে সামান্য অসুবিধা হতে পারে।’
এ বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কবির হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি কেশবপুরের তিনটি গ্রামের ৪৫০-৫০০ মানুষ ওই কুটিরশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০-২৫ বছর ধরে তারা এসব উৎপাদন ও বিপণন করে আসছেন। আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদা ১০-১২ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ ৬-৭ মেগাওয়াট। ঘাটতি বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে করণীয় বিষয়ে আমরা ভাবছি। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে সোলার প্যানেল কিংবা জেনারেটর দিয়ে এগুলোর সমাধান করা যায় কিনা সেটাও দেখা হবে। তাছাড়া, তাদের জন্যে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের বিষয়টিও আমাদের চিন্তায় আছে।’