X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬ বছরে বঙ্গোপসাগরে এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় জেলে আটক

খুলনা প্রতিনিধি
১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৩২আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১২:২১

বাংলাদেশি জলসীমা থেকে গ্রেফতার ভারতীয় জেলে

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ কমছে না। কড়া নজরদারির মধ্যেও ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ দেশের জেলেরা। গত ৬ বছরে বাংলাদেশের সীমায় প্রবেশ ও মাছ শিকারের চেষ্টাকালে ১০৩৫ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৩২ জন ভারতীয় জেলেকে বাগেরহাট কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ৪৯ জন বাগেরহাট কারাগারে বন্দি রয়েছে। অন্যরা বিভিন্ন সময় জামিনে মুক্তি পেয়ে ভারতে ফিরে গেছে। ১, ৪ ও ১৩ অক্টোবর সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় পৃথকভাবে ৪টি ট্রলারসহ ৪৯ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়।

উপকূলীয় এলাকার জেলেরা জানান, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে প্রায়ই তারা ভারতীয় জেলেদের মুখোমুখি হন। প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ আক্রমণের মুখে পড়েন। বাংলাদেশি জেলেরা একাধিকবার তাদের হামলার শিকার হয়েছেন। জেলেরা আরও জানান, ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরার ট্রলারগুলো বেশ বড়। লোকজনও বেশি থাকে। রাতের আঁধারে তারা সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়।

উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ভারতীয় জেলেরাই বেশি বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করে। মাঝে মাঝে থাইল্যান্ডের জেলেরাও আসে। ইলিশ ধরার মৌসুমেই এদের যাতায়াত বেড়ে যায়।’

জেলেরা বলেন, ‘ভারতে পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। আর আমাদের নিষেধাজ্ঞা থাকে ৬ জ্যৈষ্ঠ থেকে ১০ শ্রাবণ। বঙ্গোপসাগর একটাই। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ সময়ের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় জেলেরা এপার থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়।’

ট্রলার মালিক জলিল শেখ বলেন,‘ভারতীয় জেলেদের কাছে বড় বড় ট্রলার ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকে। কোন এলাকায় বেশি মাছ আছে, তারা তা যন্ত্র দিয়ে শনাক্ত করতে পারে। তখন তারা সংঘবদ্ধভাবে একাধিক ট্রলার নিয়ে ওই এলাকায় মাছ ধরা শুরু করে। তারা ওই স্থান থেকে বাংলাদেশি জেলেদের সরে যেতে বলে।’ তাদের মাছ ধরার জালের কারণে বঙ্গোপসাগরের এ অংশে অনেক প্রজাতির মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে, তখন ভারতীয় জেলেরা ইচ্ছামতো মাছ আহরণ করে।’

আটক ভারতীয় ট্রলার

মোংলা মৎস্য ব্যবসায়ী রবিউল, আল আমিন ও জসিম জানান, ভারতীয় জেলেদের উৎপাতে ইলিশ মৌসুমে দেশি জেলেরা মাছ শিকারে খুব অসুবিধায় পড়েন।

তারা আরও বলেন, এক সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঘেঁষে বা কিছুটা ভেতরে ঢুকে ইলিশ শিকার করতো। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি এসে অবাধে মাছ শিকার করছে। অধিকাংশ সময়ই তারা গোপনে মাছ শিকার করে চলে যায়। বিদেশি জেলেরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎপরতার ওপর চোখ রাখে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের জলসীমা ভারতের কাকদ্বীপ এলাকার কাছে হওয়ায় সেখান থেকে বিপুলসংখ্যক জেলে এদেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি জেলেরা বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায়  ট্রলার ও নৌকায় করে সামুদ্রিক নানা ধরনের মাছ আহরণ করেন। সমুদ্র শান্ত থাকায় এ সময়টা জেলেদের মাছ আহরণের উপযুক্ত মৌসুম। এ দেশের জলসীমায় সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় মাছ লুণ্ঠনের টার্গেট থাকে ভিনদেশি জেলেদের। আর সেই সুযোগ বুঝে প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের জেলেরা অত্যাধুনিক ট্রলার ও মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করে। তারা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎপরতায় চোখ রাখে এবং নৌবাহিনী আসতে দেখলেই দ্রুত পালিয়ে যায়।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্তকর্তা লে. ইমতিয়াজ আলম জানান, ‘দেশি জেলেরা সমুদ্রের ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে মাছ ধরেতে পারেন। আর ভারতীয়রা সমুদ্রসীমার প্রায় দেড়শ' কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে মাছ শিকার করে থাকে। তারা দ্রুতগামী নৌযান ও কারেন্ট জালসহ জিপিএস নামক একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে। এসব জেলেকে ধরতে নৌবাহিনীর পাশাপাশি তারাও সাগরে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’

মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, সমুদ্রসীমা লংঘনের অভিযোগে এ পর্যন্ত গ্রেফতার ৪৯ জেলের সবাই ভারতীয় নাগরিক। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর ১১ জেলেকে নৌবাহিনী আটক করে। তাদের ১৪ অক্টোবর মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। এ জেলেরা হলো−সিদ্ধিরশর গানা (৫৪),  শ্রীকৃষ্ণ (৫৩), দিপক বাড়ই (৩৫), রামকৃষ্ণ দাস (৩০), হরিপ্রধান (৫৭), সুভাষ পাল (৫২), মাইনু হানবেগ (৫৮), পিন্টু মণ্ডল (৪৮), জন্টু মৃধা (৫৫), প্রদিপ পাল (৩৫) ও গোকুল দলপতি (৩৭)।

এর আগে ৪ অক্টোবর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অপরাধে এফ বি স্বর্ণদ্বীপ ও এফবি আমৃতে নামে দুটি ফিশিং ট্রলারসহ ২৩ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করেছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা। তারা হলো−হরিরঞ্জন, শুকুমার দাস, শ্রীমন্ত দাস, নিরোদ দাস, বিশ্বজিত সাহা, অনীল পুরকাইত, গুরুপদ জানা, তপন পুরকাইত, বিজয় দাস, নিরঞ্জন দাস, প্রণব মণ্ডল, আপান্না, কালিপদ সামন্ত, কার্তিক জেনা, দুদ কুমার ভুইয়া, আভি, পাওলিয়া, নারী সাম্মা, দানিয়া, রামু, রাম, আপ্পানা। এসব জেলের বাড়ি ভারতের কলকাতার চব্বিশ পরগনা ও বিজয়নগর এলাকায়।

এর আগে গত ১ অক্টোবর একইভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের সময় ভারতীয় এফ বি মা লক্ষ্মী নামে একটি ফিশিং ট্রলারসহ ১৫ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। আটকরা সবাই ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ২২ ধারায় মামলা দায়ের শেষে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের সীমায় একটি ফিশিং বোটসহ ভারতীয় ১৩ জেলেকে আটক করে নৌবাহিনী। ওই বছরের ১৬, ১৯, ২১ ও ২৩ অক্টোবর এ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে আরও চারটি ফিশিং বোটসহ ৫৫ ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। ২৭ অক্টোবর ট্রলারসহ ৯ ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে নৌবাহিনী। ৩১ অক্টোবর দু’টি ট্রলারসহ ভারতের ২৮ জেলেকে আটক করে নৌবাহিনী। ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর ৮টি ট্রলারসহ ১০৪ জন ভারতীয় জেলেকে গ্রেফতার করে নৌবাহিনী। এ বছরের ৫ অক্টোবর একই এলাকা থেকে ৫টি ট্রলারসহ ৬১ জন ভারতীয় জেলেকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ২৭ ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি এ এলাকা থেকে ৩টি ট্রলারসহ ৩৪ ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। ৪ আগস্ট ৩টি ফিশিং ট্রলারসহ ৪২ ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর ৫টি ফিশিং ট্রলারসহ ৬১ জন ভারতীয় জেলে অটক হয়। ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি বঙ্গোপসাগর থেকে ট্রলারসহ ১০ ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। ২০১৯ সালের ৭ জুলাই চালিতাবুনিয়া এবং মৌডুবি এলাকা থেকে ৩২টি ভারতীয় ট্রলারসহ পশ্চিমবঙ্গের ৫৪২ জেলেকে আটক করা হয়।

/জেবি/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মহসিনকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত সাব্বির-কায়সার-বিপ্লবরা
মহসিনকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত সাব্বির-কায়সার-বিপ্লবরা
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
ওষুধের দাম নিয়ে যে নির্দেশ দিলেন হাইকোর্ট
ওষুধের দাম নিয়ে যে নির্দেশ দিলেন হাইকোর্ট
বাসচাপায় মাইক্রোবাসের ২ যাত্রী নিহত
বাসচাপায় মাইক্রোবাসের ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড