গত বৃহস্পতিবার ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মৃত আব্দুর রহিম খানের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক প্রিন্স। তার সফলতার গল্পটা সহজ ছিল না। কৃষক পরিবারের এই সন্তান ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এরই মধ্যে মা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। কিছুদিন পরে বাবার মৃত্যু হয়েছে। সবমিলিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়েছে কয়েকবার। শেষমেশ সব বাধা পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। হয়েছেন সফল।
উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের আমকাঁঠালিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট তিনি।
রবিবার (০৬ আগস্ট) সকালে আমকাঁঠালিয়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার খবরে আবু বক্কর সিদ্দিকের বাড়িতে দেখা করতে আসছেন স্বজনরা। অনেক প্রতিবেশীও আসছেন। ছেলের এমন কৃতিত্বে দারুণ খুশি মা পারুল খাতুন। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করছেন তিনি।
পারুল খাতুন বলেন, ‘আমার তো বাঁচার কথা নয়। এমনও দিন গেছে, মনে হয়েছিল বুঝি মারা যাচ্ছি। ছেলে অনেক জায়গায় নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। আল্লাহর রহমতে এখনও বেঁচে আছি। হয়তো ছেলের এই সফলতা দেখাবেন বলে বাঁচিয়ে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
আমার এক ছেলে এক মেয়ে, তাদের মানুষ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে জানিয়ে পারুল খাতুন বলেন, ‘তাদের বাবার তেমন কোনও জায়গা জমি নেই। গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করে বহু কষ্টে তাদের লেখাপড়া করিয়েছি। সেইসঙ্গে সংসারের খরচ চালাতে হয়েছে। অবশেষে সফল হলো ছেলে।’
আবু বক্কর সিদ্দিকের বড় বোন সুলতানা রাজিয়া রুপা খাতুন বলেন, ‘বাবা-মা অনেক কষ্ট করে আমাদের লেখাপড়া করিয়েছেন। মায়ের অসুস্থতা ও বাবার মৃত্যুর পর অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়েছে বারবার। তবে ভাইয়ের সাফল্য দেখে যেতে পারলেন না বাবা। বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।’
আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না উল্লেখ করে আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের। চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। আর্থিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি পড়তে হয়েছে। তবু সবসময় নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ ঠিক রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার পর আর্থিক সংকটের কারণে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি না হয়ে বাড়ির পাশে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখান থেকে এইচএসসি পাসের পর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে ভর্তি হই। কারণ প্রথমবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাইনি। পরের বছর দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পাই। পরের পাঁচটা বছর কাজে লাগিয়েছি পড়াশোনায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি জানিয়ে আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘কোচিং সেন্টারেও ক্লাস নিয়েছি। এর মধ্যে ২০১৯ সালে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ে। মায়ের অসুস্থতার কারণে পড়ালেখার বাইরে ছিলাম অনেকদিন। তবে এখন মায়ের ক্যানসার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপর ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতার কারণে মারা যান বাবা। তখন ভেঙে পড়েছিলাম। তবে মনোবল হারায়নি। নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে গেছি।’
পড়াশোনা শেষে ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি উল্লেখ করে এই বিসিএস ক্যাডার বলেন, ‘শিক্ষকতা করে সংসারের হাল ধরেছি। এর পাশাপাশি বিসিএসের জন্য দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লেখাপড়া করেছি। ইচ্ছে ছিল পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাবো। তবে হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে। এতে আমি খুশি।’