X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী আশঙ্কামুক্ত

হামলাকারীরা হিজবুত তাহরীরের ‘বহিরাগত সদস্য’

আনিসুর রহমান স্বপন, বরিশাল
১৬ জুন ২০১৬, ২৩:২৭আপডেট : ১৭ জুন ২০১৬, ০০:২৮

অবস্তার উন্নতি ঘটেছে শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর রিপন চক্রবর্তীর হামলাকারীরা ’হিজবুত তাহরীর’-এর সদস্য। তারা হামলার দিনই মাদারীপুরে এসেছে। মাদারীপুরের এসপি সরোয়ার হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।

দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত মাদারীপুরের নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তী বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তিনি কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সরফুজ্জামান রুবেল।

তার স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো হাতে পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন রিপনের মুখে খাবার দেবেন কিনা। বুধবার রাতে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই রিপন চক্রবর্তীর জ্ঞান ফিরে। তিনি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কথা বলতে শুরু করেন। রোগীর অবস্থার কথা বিবেচনা করে প্রথমে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিলো। পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে তাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। তবে বেশ কিছুদিন তাকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন ডা. এএসএম শরফুজ্জামান রুবেল।

বরিশালে শেবাচিম হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড-২ এর অধিনে ৩৪ নং কেবিনে তিনি চিকিৎসাধীন।

হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পরিচালক ডা. নাজমুল হক বলেছেন তার অবস্থা উন্নতির দিকে, জীবনাশঙ্কা কাটিয়ে উঠিয়েছেন তিনি। মাথায় ৪টি, হাতে ও কানে ২টি আঘাত রয়েছে। তার ক্ষত স্থানে সবমিলিয়ে ২০ থেকে ২২টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হওয়ায় ৪ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে তাকে। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড থেকে বের করে রিপন চক্রবর্তীকে সিটিস্ক্যান ও এক্স-রে করার জন্য নেওয়া হয়। তবে সিটি স্ক্যান ও এক্স-রে রিপোর্ট ভালো।

বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদারীপুর ডিবি’র পরিদর্শক কামরুল হাসান এর নেতৃত্বে একটি দল শেবাচিমে রিপন চক্রবর্তী ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তবে তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক কামরুল হাসান। তিনি জানান, প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধরার জন্যে অভিযান চলছে।

এদিকে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রিপন চক্রবর্তী তাদেরকে বলেন হামলাকারীরা তার অচেনা। কলেজ থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় তিনি আকস্মিক হামলার শিকার হন। এ হামলার কারণও তিনি জানেন না। তিনি ধর্মভীরু এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি  নিয়মিত পালন করলেও কোন ব্লগে লেখালেখি করেন না বা স্ট্যাটাস দেন না। 

তবে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় আটক গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম কথায় কথায় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দেন। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকার উত্তরায় তার কলেজের সিনিয়র ব্যাচের ছাত্র জুবায়ের আহমদ তাকে এ পথে এনেছেন। কলেজের সামনের ‘মিশকাত লাইব্রেরি’র দুইজন স্টাফও তাদের সঙ্গে আছেন। তবে তারা বেশি লোককে চেনেন না। মোবাইল ফোনে কথা নয়, তারা সাংকেতিক এসএমএস-এর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। বিদেশি জঙ্গি গোষ্ঠির সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল। জুবায়েরের নির্দেশেই সে মাদারীপুর এসেছে। ঢাকার এক সিটি মেয়রও দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে ফাইজুল্লাহ দাবি করেছে বলে এই সূত্রে জানা গেছে।

রিপন চক্রবর্তীর স্ত্রী মনিমালা রায় গৌরনদী পালরদী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। হাসপাতালে তিনি বলেন, ‘আমি চাকরি করার কারণে রিপন মাদারীপুরে ভাড়া বাসায় একাই থাকে। কারা, কী কারণে তাকে কুপিয়েছে কিছুই জানি না।’

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বিলগ্রাম গ্রামের প্রয়াত রবি চক্রবর্তীর ছেলে রিপন চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন।

পালরদী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস জানান, রিপন ছাত্রজীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় ভক্ত ও শিষ্যদের বাড়িতেও পূজায় সেবায়েত,  পুরোহিত হিসেবে কাজ করেন।

রিপনের কাকাতো ভাইয়েরা বলেন, রিপন মাদারীপুরে চাকরি করার আগে ও পরে সেবায়েত হিসেবে এলাকায় কাজ করেন। বিভিন্ন সময় ভক্ত ও শিষ্যদের বাড়িতেও পূজায় পুরোহিত হিসেবে কাজ করেন।

জঙ্গি হামলায় আহত কলেজ শিক্ষক সম্পর্কে তার ভাই স্বপন চক্রবর্তী জানান, তার বাবা রবীন্দ্র চক্রবর্তী পেশায় একজন যজমান (পুরোহিত) ছিলেন। তারা ২ ভাই ২ বোন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলের তার ভাই রিপন চক্রবর্তী। শুধু মেধাবী নয় তার মত ভদ্র ও ভাল লোকও কেউ নেই।

রিপন চক্রবর্তীর পিতার বাড়ি বরিশাল জেলার মাহিলারা ইউপির বিল্বগ্রামে। প্রায় ৭ একরের মতো কৃষিজমি তাদের। কোনও মামলা মোকদ্দমা নেই তাদের।

‘আমাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই- তার মতো ভদ্র লোকের ওপর হামলা হবে এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।’

পড়াশোনা ও চাকরি

স্বপন চক্রবর্তী জানান, শিক্ষাজীবনে মেধা ছাত্র ছিলেন রিপন চক্রবর্তী। বিল্বগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পালরদী হাইস্কুলে তিনি ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়, এরপর মাদারীপুরের কালকিনির শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে ভালো ফল অর্জন করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। সেখান থেকে দ্বিতীয় বিভাগে অনার্স ও প্রথম বিভাগে মাস্টার্স শেষে ২০০৯ সালে ঝালকাঠী কলেজে যোগ দেন। এরপর একে এক শিবচরের বোরহানগঞ্জ, বরিশালের হাতেম আলী কলেজে চাকরি করার পর মাদারীপুরের নাজিমউদ্দিন কলেজে ৮ মাস আগে যোগ দেন তিনি।

স্বপন বলেন, কোনও রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনে তার জড়িত থাকার তথ্য জানি না আমরা। তবে ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবল। সরস্বতী পূজায় গীতা পাঠ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে গীতা পাঠ করেন তিনি। গ্রামের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তার। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। বাড়িতে কালীপূজা নিয়েও কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল না।

স্বপন আরও বলেন,‘আমাদের চৌদ্দ পুরুষ থানা–পুলিশ দেখেনি। জীবনে কারও সঙ্গে ভাইয়ের বিবাদ হয়নি। আমরা মনে করি এলাকার কারও ইন্ধনে বা পেশাগত কোনও বিষয়ে অন্য এলাকার জঙ্গিরা এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে’।

হাতেম আলী কলেজে তার সাবেক সহকর্মী হারুন অর রশিদ জানান, রিপন স্যার কম কথা বলেন। খুবই ভদ্র ছিলেন। তার কোনও শত্রু থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করি না। স্যারকে কেউ বকা দিলে তিনি হজম করে যাবেন, তবু প্রতিবাদ করবেন না।

কলেজের স্টাফ মিরাজ জানান,  স্যার খুবই নিরিবিলি ও ভদ্র ছিলেন। এবার সরস্বতী পূজাও স্যারের নেতৃত্বে হয়েছে। তার সঙ্গে কারও কোনও দ্বন্দ্ব নেই।

আহত শিক্ষকের ছাত্র ইফাত জানান, আমরা স্যারের সঙ্গে কারও কোনও সমস্যার কথা শুনিনি। তার মতো নিরিবিলি মানুষ খুব কম হয়।

এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, আটক হামলাকারী গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম ঢাকার বাসিন্দা।  তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পৌর এলাকার দারিয়াপুরে। বাবা গোলাম ফারুক ২২ বছর ধরে গ্রামের বাড়িতে থাকেন না, ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ফাহিমের জন্ম ঢাকায়। নানাবাড়ি কক্সবাজারে।

মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ফাহিম ঢাকার উত্তরার রাজউক কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। তাঁর মামা ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে কর্মরত। বাড়িতে থাকা চাচা মো. এমদাদুলের বরাত দিয়ে তিনি এসব তথ্য জানান ।

ফাহিমের বাবা গোলাম ফারুক বলেন, ‘১২ জুন ফাহিমের একটি পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার আগের দিন সে বাড়ি ছাড়ে। এ ব্যাপারে দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য র‌্যাবের কাছেও আবেদন করা হয়েছে। দুই ভাইবোনের মধ্যে ফাহিম বড়।

জিডির বরাত দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম বলেন, ১১ জুন গোলাম ফারুক জিডিটি করেন। এতে বলা হয়, ওই দিন ফাইজুল্লাহ ব্যবহারিক (প্রাকটিক্যাল) খাতা নিয়ে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে তাদের দক্ষিণখান থানার ১২৯ ফায়দাবাদের টিআইসি কলোনির বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

/টিএন/

আপ: এইচকে
আরও পড়ুন: টুটুলকে তিনটি কোপ দিয়েছিল শিহাব

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ