দুর্ভিক্ষের পর ৪২ বছর কেটে গেছে। বাসন্তির রঙ বদলায়নি। বদলায়নি তার ভাগ্যও। দুর্ভিক্ষের সময় শরীর ঢেকেছিলেন মাছ ধরার জালে। ক্ষুধা নিরাবণ করেছিলেন কলা গাছের মজ্জায় (স্থানীয় ভাষায় মাঞ্জা)। সেই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি হয়ে দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছিলেন কুড়িগ্রামের বাসন্তি। খাবারের সন্ধানে সেই বাসন্তির নিরন্তর ছুটে চলার গল্প আজও শেষ হয়নি।
যদিও সেই ছবির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বাসন্তির দুরাবস্থা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। কখনও ভিক্ষা করে আবার কখনও কারও সাহায্য নিয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে হয় স্বামী পরিত্যক্তা নিঃসন্তান বাসন্তিকে। দেশে নতুন করে আর দুর্ভিক্ষ আসেনি। কিন্তু সেই বাসন্তিকে বারবার খাবারের জন্য মানুষের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় এবারের বন্যায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্রহ্মপুত্রের বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলা বন্যার পানি বাসন্তির ঘরকেও এক বুক গভীরতায় নিমজ্জিত করে রেখেছিল ১২ দিন। জীবন বাঁচাতে ভাইয়ের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন মণ্ডলপাড়ার খরখড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু খাবারের জন্য ছুটে যেতে হয়েছে ত্রাণ সংগ্রহে। এরপর ঘর থেকে পানি নেমে গেলে বাসন্তি তার ভাই আর ভাতিজাদের নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে।
রবিবার (৭ আগস্ট) দুপুরে বাসন্তিকে আবার দেখা যায় রমনা ইউনিয়ন পরিষদের চত্বরে। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন (বাংলাদেশ)- এর উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে শতশত নারী পুরুষের ভিড়ে মাথায় কদম ছাঁটনির বাসন্তিকে চিনতে বেগ পেতে হয় না কারও। আর বাক প্রতিবন্ধী বাসন্তিকেও সবাই মানবিকতার পরিচয় দিয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন সামনের সারিতে বসার। রোদের প্রখরতায় চোখের পাতা ছোট করে বাসন্তি তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন চারদিকে। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, বাংলাদেশ- এর কর্মকর্তারা যখন বাসন্তির হাতে মিষ্টি কুমড়া আর বিভিন্ন উপকরণ সম্বলিত ত্রাণের ব্যাগ তুলে দিলেন, তখন বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া বাসন্তি তা বহন করতে পারছিলেন না। প্রতিবেশী ফুলাল চন্দ্র দাস এবং কয়েকজন সাংবাদিক এগিয়ে এলেন বাসন্তিকে সহায়তা করতে। শেষে ফুলাল চন্দ্রের ওপর দায়িত্ব পড়ে বাসন্তিকে ত্রাণসহ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার।
বাসন্তির প্রতিবেশী ফুলাল চন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক কষ্টে দিন যায় বাসন্তির। চিলমারীর রমনা ইউনিয়নের জোরগাছ গরুরহাটের দক্ষিণে ভাই আশুরাম দাসের বাড়ির পাশেই একটি টিনের চালা ঘরে থাকেন বাসন্তি। এই গ্রামকে সবাই বাসন্তি গ্রাম নামেই চেনে। স্বামী পরিত্যক্তা ষাটোর্ধ বাসন্তির কোনও সন্তান নেই। দুই ভাতিজা মিলন আর যুগল এবং তাদের মা নিরোবালা বাসন্তির দেখাশোনা করেন। কিন্তু দরিদ্রতার জন্য তারাও সবসময় তাকে দেখে রাখতে পারেন না। বেঁচে থাকার তাগিদে বাসন্তিকে তাই খাবারের জন্য মাঝে মাঝে ভিক্ষাও করতে হয়।
বাসন্তি নামের এই নারী দেশ-বিদেশে পরিচিতি পান স্বাধীনতার পর দুর্ভিক্ষের সময়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে আকস্মিকভাবে বড় ধরনের বন্যা শুরু হলে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ঘরে ঘরে দেখা দেয় খাদ্যাভাব।
এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন মজুমদার দুর্ভিক্ষের খোঁজ-খবর নিতে আসেন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আসেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ।
ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ তৎকালীন রমনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনসার আলীকে সঙ্গে নিয়ে যান রমনার জেলে পল্লীতে। সেখানে শরীরে মাছ ধরার জাল পরিহিত বাক প্রতিবন্ধী বাসন্তি কলা গাছের ভেলায় চড়ে কলা গাছের মাঞ্জা সংগ্রহে ব্যস্ত। আরেক নারী বাঁশ হাতে অন্য প্রান্তে বসে ভেলা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। এই ছবি তোলেন আফতাব আহমেদ।
পরে সেই ছবি সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্রই দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। যদিও ছবিটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে,সেটি প্রকৃত দৃশ্য নাকি পরিকল্পিতভাবে তোলা।
বাসন্তিকে জাল পড়ানো হয়েছিল, নাকি দারিদ্র্যের কারণে বস্ত্রহীন বাসন্তি নিজেই জাল পড়ে সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন, তা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে। বাসন্তি বাক প্রতিবন্ধী হওয়ায় আজও এর সদুত্তর মেলেনি।দেশে খাদ্যের ঘাটতি না থাকলেও বাসন্তির খাবার জোটে না। জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত এই নারী আজও খাদ্যের সন্ধানে ছুটছেন। কখনও ভিক্ষা করতে আবার কখনও ত্রাণের খোঁজে। তার খাদ্যের অভাব আজও শেষ হয়নি।
রমনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজগর আলী সরকার জানান, ত্রাণ সহায়তা ছাড়াও সরকারের যেকোনও সাহায্য-সহযোগিতা বাসন্তিকে দেওয়া হয়ে থাকে।
বাসন্তি বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (অতি. দা.) এস এম মমতাজুল ইসলাম জানান, বাসন্তিকে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়।
তবে স্থানীয়দের দাবি, বাসন্তির খাদ্য ও বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ত্রাণের জন্য আর যেন ছুটে বেড়াতে না হয় বাসন্তিকে।
ছবি: আরিফুল ইসলাম
আরও পড়ুন: গাইবান্ধার চরাঞ্চলে ডাকাত আতঙ্ক, পাহারা দিতে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ
/বিটি/এপিএইচ/