১৪ মাস বয়সি শিশু লামিম। তার মা লাইলী বেগম (মৃগী রোগী) গত ১২ জুলাই বাড়ির কাছে পানিতে পড়ে মারা যান। এরপর থেকে লামিম, তার ভাই লাজিম (৭) ও বোন সিনহা তাদের দাদী বানভাসির কাছে রয়েছে। মা হারানো এই শিশুদের তিনবেলা খাবার জোটাতে হাঁপিয়ে উঠছেন তাদের দাদী বানভাসি।
সোমবার (১৭ জুলাই) চিলমারী উপজেলার শাখাহাতি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া যখন ত্রাণ বিতরণ করছিলেন তখন ত্রাণ গ্রহীতাদের লাইনে বানভাসির সঙ্গে ছিল চৌদ্দ মাসের শিশু লামিম ও তার ভাই লাজিম। বানভাসি (৫৭) তখন জানান, তারা শাখাহাতি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭ নং ব্যারাকে থাকেন। তার ছেলের বৌ লাইলী বেগম মৃগী রোগী ছিলেন। কিন্তু ছয় দিন আগে ভোরবেলায় ব্যারাকের পাশে বন্যার পানিতে পড়ে মারা যান লাইলী। গত ছয়দিন ধরে প্রতিবেশির কাছ থেকে কেনা গাভীর দুধ খেয়ে দিন যাচ্ছে মা হারা শিশু লামিমের। আর লাজিম কী খাচ্ছে, কী খাচ্ছে না সেদিকে তাকানোর সুযোগই পাচ্ছেন না।
বানভাসি বলেন, ‘বাচ্চাটার মা মরি যাওয়ার পর কী খাওয়াই না খাওয়াই কোনও দিশা পাই না বাবা। হ্যার বাপেরও কোনও কাজ নাই। প্রত্যেকদিন আধ সের করি গাইয়ের দুধ কিনি ছাওয়াটাক খাওয়াবার লাগছি।’
ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করে বানভাসি জানান, ‘আগত (আগে) ১০ কেজি চাউল পাছি, তাকে দিয়া এই কয়দিন কোনোরকম খায়া আছি। কিন্তু এই অবুঝ ছাওয়াটাক কী দিয়া দুধ কিনি খাওয়াই, ইয়ার বড়টাকও (বড় ভাই লাজিমকে) বা কী খোয়াই!’
শিশুগুলোর বাবা ছাইদুল জানান, বন্যার কারণে হাতে কোনও কাজ নেই তার। শিশুদের কীভাবে লালন-পালন তা বুঝতে পারছেন না। প্রশাসন থেকে কোনও অর্থ সহায়তা পেয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে ছাইদুল জানান, ‘লোক মুখে শুনছি আমার নামে নাকি সরকার টাকা দেবে। কিন্তু আমি কোনও টাকা পাই নাই।’
কুড়িগ্রামে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও অনেক বাড়ি-ঘর থেকে পানি নামেনি। ফলে দুর্ভোগ থেকে সহসাই রেহাই মিলছে না কুড়িগ্রামের ৬টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নের বন্যাদুর্গতদের। পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকজন কর্মহীন হয়ে রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তিনবেলা খাবার জোগার করা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বসতবাড়ির চারপাশে পানি জমে অধিকাংশ সবজি খেত পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে আক্রান্ত পরিবারগুলো। বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকায় ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শিশু খাদ্য নিয়ে সংকটে থাকার কথা জানিয়েছেন উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চরের জেসমিনও। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার দেড় মাস বয়সি একটি কন্যা সন্তান আছে। কিন্তু নিজে ঠিকমতো খাবার না পাওয়ায় বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না। অন্য দুই শিশু সন্তানের জন্যও দুবেলা ঠিকমতো খাবার জোগার করতে পারছেন না জেসমিন। তার স্বামী তাঁতের কাজ করলেও এখন বেকার হয়ে বাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় সময় পার করছেন। ফলে পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, সন্তানদের জন্য তিনবেলা খাবার জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
একই ইউনিয়নের বতুয়ার চর, চর দক্ষিণ, বালাডোবাসহ বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকায় দুর্গতদের মধ্যে একই রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মির্জা মুরাদ হাসান বেগ ট্রিবিউনকে জানান, ‘নিহত লাইলী বেগমের আইনানুগ অভিভাবকদের আমরা পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা শিগগিরই দেওয়া হবে।’ শিশুখাদ্যের ব্যাপারে এই নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ‘সরকার থেকে আমরা যে ধরণের খাদ্যসামগ্রী পেয়েছি তাই বিতরণ চলছে। শিশুদের জন্য আলাদা করে কোনও খাদ্যদ্রব্য এখনও বিতরণ করা হয়নি।’
কুড়িগ্রাম জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাহানা আক্তার জানান, ‘আমরা বন্যা কবলিত শিশুদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছি। তালিকা প্রস্তুত হলে তাদের জন্য শিশু খাদ্য সরবররাহ করা হবে।’
কুড়িগ্রামের ডিসি আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। মৃত লাইলী বেগমের শিশুসহ এমন আরও শিশুদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে তাদের শিশুখাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’
/এফএস/