X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৭ ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত, মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

তৌহিদ জামান, যশোর
২২ মে ২০১৮, ২১:৩১আপডেট : ২৩ মে ২০১৮, ১০:৩৬

২০ মে দিনগত গভীর রাতে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত একজনের লাশ (ছবি- প্রতিনিধি)

গত তিন দিনে যশোরে র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এবং ‘নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে’ সাত জন মারা গেছেন। পুলিশ ও র‍্যাবের দাবি, এরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। তবে স্থানীয় সূত্রের দাবি, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যারা নিহত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই ছিঁচকে মাদক ব্যবসায়ী। এ তথ্য স্বীকার করে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের গডফাদাররা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

১৮ মে অভয়নগর উপজেলার বাগদহ-কদমতলা এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তিন জন। এরা হলেন– উপজেলার নওয়াপাড়া এলাকার নাদের আলী মোড়লের ছেলে আবুল কালাম (৪৭), বারিক শেখের ছেলে হাবিবুর শেখ (৩৮) এবং আব্দুস সাত্তার কাসারীর ছেলে মিলন কাসারী (৪০)।

স্থানীয়রা জানায়, নিহত তিন জন মূলত মাদকসেবী ছিল। তারা ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবন করতো। প্রতি সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে বসে নেশা করতো। সম্প্রতি তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।

সূত্র আরও জানায়, মিলন কাসারীর ভাই ডেকোরেটর ব্যবসা করেন। মিলনের আগে থালা-বাসনের দোকান ছিল। পরে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার ভাই তাকে মাসে মাসে হাত খরচের টাকা দিতেন। আবুল কালাম ঠেলা গাড়িতে করে মুড়ি-মসলা, পিঁয়াজু ইত্যাদি বিক্রি করতেন। আর পাঁচ কবর এলাকার হাবিবুর শেখ ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান।

নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রবীন অধিকারী ব্যাচা বলেন, ‘নিহত তিন জনই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তারা এলাকায় সেবনসহ মাদক বেচাবিক্রির কাজ করতো।’

অভয়নগর থানার ওসি শেখ গণি মিয়া বলেন, ‘নিহত তিন জনই মাদক ব্যবসায়ী। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় দুই থেকে চারটি করে মামলা রয়েছে।’

তিনি আরও জানান, ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পর র‍্যাব-৬ খুলনা ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে একটি পালসার মোটরসাইকেল, দু’টি পিস্তল, গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, ৫০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে।

২০ মে দিনগত গভীর রাতে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত আরও একজনের লাশ (ছবি- প্রতিনিধি)

১৯ মে ভোরে যশোর-ছুটিপুর রোডের সুজলপুর এলাকায় আকবর মিয়ার রড ফ্যাক্টরির পাশে ‘গোলাগুলি’তে নিহত হন ডালিম হোসেন (৩৫)। শহরের শংকরপুর এলাকার মৃত সোহরাব হোসেনের ছেলে ডালিম খোলাডাঙ্গা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি পিকআপ ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

স্থানীয় লোকজন জানায়, বছর পাঁচ আগে তিনি শংকরপুর এলাকার বাসিন্দা মাদক চোরাকারবারি তারেকের সহযোগী ছিলেন। তারেক বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি মাদক চোরাচালানের কাজ ছেড়ে গাড়ির ব্যবসায় মন দেন।

নিহতের খালা বেবি জানান, ১৮ মে রাতে সাদা পোশাকের ৭-৮ জন ডালিম হোসেনকে খোলাডাঙ্গার বাসা থেকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তাকে অনেক খোঁজাখুজি করেও পাওয়া যায়নি। পর দিন তারা জানতে পারেন, হাসপাতালে ডালিমের লাশ আছে। পরে সেখানে গিয়ে তারা ডালিমের লাশ শনাক্ত করেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি আজমল হুদা জানান, নিহত ডালিমের বিরুদ্ধে থানায় মাদক সংক্রান্ত আইনে ৭টি মামলা রয়েছে।

২০ মে যশোর সদরের খোলাডাঙ্গা ও মণ্ডলগাতির মাঝামাঝি এলাকা এবং তরফনওয়াপাড়ায় ‘নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি’তে তিন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। এর মধ্যে প্রথম ঘটনাস্থল থেকে একজন এবং দ্বিতীয় ঘটনাস্থল থেকে দু’জনের লাশ, ইয়াবা, অস্ত্র উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানায়। এই তিন জনের নাম হলো– সিরাজুল ইসলাম ওরফে দুখি (৪০), মুত্তাজুল মোড়ল ওরফে মুক্তা (৩৫) এবং শফিকুল ইসলাম শফি (২৮)। দুখি ও মুক্তা শার্শা উপজেলা এবং শফি চৌগাছা উপজেলার বাসিন্দা। দুখি শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের টেংরা-জামতলার রহমান গাজীর ছেলে ও মুক্তা একই উপজেলার মহিষাকুড়া গ্রামের হারুনুর রশিদের ছেলে। আর শফিকুল ইসলাম শফি চৌগাছা উপজেলার বড় আন্দুলিয়া এলাকার শুকুর আলী মোল্যার ছেলে।

১৯ মে ‘গোলাগুলি’তে নিহত ডালিম (ছবি- প্রতিনিধি)

নিহত সিরাজুল ইসলাম দুখীর ছেলে রিপন হোসেন দাবি করেন, তার বাবা একজন কৃষক। ১৯ মে ভোররাতে দু’টি সাদা মাইক্রোবাসে ৭-৮ জন লোক পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাড়ি থেকে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর খোঁজ-খবর নিয়েও তার কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। সোমবার সকালে লোকমুখে খবর শুনে যশোর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে এসে তিনি তার বাবার লাশ শনাক্ত করেন।

মুক্তার বড় ভাই সোহরাব হোসেন দাবি করেন, ১৯ মে সেহরির সময় দু’টি সাদা মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন পুলিশ তার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তারা তাদের ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছিলেন না। পরে খবর পেয়ে হাসপাতালের মর্গে এসে দেখেন, সেখানে তার ভাইয়ের লাশ রয়েছে। তার মাথার পেছনে গুলি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য বাগআঁচড়া ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াস কবীর বকুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। 

শার্শা থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, ‘দুখী ও মুক্তা খুবই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে থানায় মাদক আইনে ৮-৯টি করে মামলা রয়েছে।

তিনি আরও দাবি করেন, ‘মাস তিনেক আগে মাদকসহ দুখিকে আটক করা হলে সে ও তার পরিবারের লোকজন একজন পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়।’

চৌগাছার সুখপুকুরিয়া এলাকার লোকজন জানায়, শফিকুল ইসলাম বেশ বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী। সে মূলত ফেনসিডিল ও ইয়াবার ব্যবসা করে। বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। কিন্তু কেমন করে যেন প্রতিবারই বেরিয়ে এসেছে।

২০ মে ‘গোলাগুলি’তে নিহত সিরাজুল ইসলামের ভোটার আইডি (ছবি- প্রতিনিধি)

সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. তোতা মিয়া বলেন, ‘দুপুরের দিকে যশোর কোতোয়ালি থানার একজন পুলিশ অফিসার আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, শফিকুল নামে একজনের লাশ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। সেটি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এর আগে আমি জানতাম না, শফিকুল ইসলাম মারা গেছে।’ সে মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলেও তিনি জানান।

চৌগাছা থানার ওসি খন্দকার শামিম উদ্দিন বলেন, ‘শফিকুল নামে কেউ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, এটি প্রথমে আমি জানতাম না।’ তার বিরুদ্ধে থানায় কোনও মামলা রয়েছে কিনা –এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোতোয়ালি থানায় যোগাযোগের পরামর্শ দেন। শফিকুল তার থানা এলাকার জানালে তিনি বলেন, ‘আমি বাইরে আছি। আপনাকে একটা নম্বর দিচ্ছি, সেখানে যোগাযোগ করেন।’ কিন্তু তিনি সেই নম্বর দেননি। পরে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি আর তা ধরেননি।

এদিকে,একটি গোয়েন্দা সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, যশোর জেলার ৮ উপজেলায় শতাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এর মধ্যে যশোর সদরে ৫০ জনের মতো, শার্শায় ২৫ জন, অভয়নগরে ২০ জন, ঝিকরগাছায় ২০ জন, বাঘারপাড়ায় ৫-৬ জন, মণিরামপুরে ৭-৮ জন, চৌগাছায় ৭ জনের মতো রয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, যশোর শহরের শংকরপুর, বেজপাড়া, বারান্দিপাড়া, পুরাতন কসবাকেন্দ্রীক কয়েকজনের সিন্ডিকেটে মাদক ব্যবসা পরিচালিত হয়।

সূত্র জানায়, অভয়নগর উপজেলায় লিপি বেগম, তার বাবা আনোয়ার, স্বামী হিরু মোল্যা, ছেলে সুমন, মেয়ে রূপা ও তার জামাই আলীর নেতৃত্বে মাদক ব্যবসা পরিচালিত হয়। এ ছাড়া, গুয়াতলার কামরুল, ভাঙাগেট এলাকার নূরু মল্লিক ও তার জামাই রতন, চেঙ্গুটিয়ার হালিম, ড্রাইভারপাড়ার শহিদুল, বুইকরা এলাকার মিজান ওরফে জিএম প্রমুখ নওয়াপড়ায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে। স্থানীয় সূত্রও জানায়, এখানকার একজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির ছত্রচ্ছায়ায় তারা মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যশোরের চৌগাছা উপজেলায় যে ক’জন বড় মাপের মাদক কারবারি ছিল, তার মধ্যে গত বছরের শেষদিকে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় একছের আলী ও শফিকুল। এ উপজেলায় আরও ক’জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরা হচ্ছে– শফিকুল মেম্বর, ইসমাইল ও নুনু খোকন।

শার্শায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাদশা মল্লিক সম্প্রতি ভারতে আটক হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সেখানে স্থানীয় রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ মদদে মাদক ব্যবসা পরিচালিত হয় বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র।

ঝিকরগাছা উপজেলা এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আক্তার, সোহাগ, টোকন, সুমন, জামশেদ, পলাশ প্রমুখ। এর মধ্যে এ বছরের প্রথমদিকে আক্তার অস্ত্র ও মাদকসহ র‌্যাবের হাতে আটক হয়। পরে ছাড়াও পেয়ে যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি মহলের ছত্রছায়ায় সে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

/এমএ/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
বাংলাদেশের আম নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম নিতে চায় চীন
গাজীপুর-নীলফামারীর দুই হাসপাতালে দুদকের অভিযান
গাজীপুর-নীলফামারীর দুই হাসপাতালে দুদকের অভিযান
এলপিএলের ড্রাফটে চার বাংলাদেশি
এলপিএলের ড্রাফটে চার বাংলাদেশি
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ