X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁও-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেন আর কতদূর?

জাকির মোস্তাফিজ মিলু, ঠাকুরগাঁও
২৪ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:২৮আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:৩৪

 

আন্তনগর ট্রেনের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, কর্তৃপক্ষের বারবার প্রতিশ্রুতি ও নতুন অবকাঠামো নির্মাণে ৯শ’ ৮২ কোটি টাকা ব্যয় করার পরও চালু হয়নি পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেন। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, রেললাইন ও প্ল্যাটফরম আধুনিকায়ন, মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ সবই হয়েছে। শুধু এখনও আন্তঃনগর ট্রেনের হুইসেলটা শুনতে পেল না অবহেলিত জনপদ বলে কথিত ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ের মানুষ। এখানকার মানুষের প্রতীক্ষায় অবসান হলো না আজও পর্যন্ত।

গত চারটি ঈদ থেকে আন্তঃনগর ট্রেন চালু হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রাক্তন মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন এমপি বারবারই ট্রেন চালু হবে বলেন। কিন্তু ট্রেন আর আসে না। ঈদে এ জেলার ঘরেফেরা মানুষেরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ থেকে কিছুটা রেহাই পাবেন আশা করেও বারবার নিরাশ হচ্ছেন। বরং তার পরিবর্তে ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড়ের সাধারণ মানুষকে হতাশ করে ২০১৭ সালের জুলাই মাসের ১৭ তারিখে পঞ্চগড় রেলস্টেশনে এক অনুষ্ঠানে শাটল ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।

এ সময় পঞ্চগড় থেকে ঢাকা সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চালুরও ঘোষণা দেন তিনি। এরপরেও একাধিক সংসদ সদস্য ওই লাইনে সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের আশ্বাস দিলেও কার্যত এর কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু দিনাজপুর-পঞ্চগড় রেলপথ ও ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশনটি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে।

এ প্রকল্পে ৯শ’ ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০১০ সালের অক্টোবরে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থেকে ঠাকুরগাঁও হয়ে পঞ্চগড় পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটারের মিটার গেজ রেলপথকে আধুনিকায়ন,সম্প্রসারণ ও ডুয়েল গেজে রূপান্তর করার কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই বার নির্মাণকাজের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ করার অঙ্গীকার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা ও ম্যাক্র কনস্ট্রাকশন। সর্বশেষ মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠান দুটি প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ করতে পারে। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৯০ কি. মি. রেলপথের মধ্যে ১৩১টি ছোট ব্রিজ ও ৩টি বড় ব্রিজ পুনর্নির্মাণ ও রেলস্টেশন পুনর্নির্মাণ কাজ।

পরবর্তী কালে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর রেলমন্ত্রী পঞ্চগড়ে এসে প্রত্যাশার আন্তঃনগর ট্রেনের পরিবর্তে শাটল ট্রেন উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত নেতারা এবং সাধারণ মানুষ সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চালুর দাবি করলে মন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দাবির প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল। জনগণের দাবি মেনে দ্রুত আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হবে। আগামী ২০ জুন ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫০টি উন্নতমানের ব্রডগেজ রেল কোচ আমদানির জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। সেই কোচ এলেই পঞ্চগড় থেকে সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হবে।’

এর পরেও অজ্ঞাত কারণে চালু হয়নি ঢাকা- ঠাকুরগাঁও- পঞ্চগড় সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন। সে সময় সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চালুর দাবিতে ফুঁসে ওঠে দুই জেলার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন চালু না হওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছেন সাধারণ মানুষ। এরপরও একাধিকবার দায়িত্বশীল নেতারা সরাসরি ট্রেন চালু করার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। নেতারা বারবারই আগামী ঈদের আগেই আন্তঃনগর ট্রেন চালু হতে পারে, বললেও ৪টি ঈদ গত হয়েছে, ট্রেন চালু হয়নি। নতুন বছরে শুরুর কথা বলা হলেও নতুন বছরটিও শেষ হচ্ছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী গত ২৯ মার্চ আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে রেল মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে চিঠিও যায়।

রেলের পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বললেই তো আর নতুন ট্রেন হচ্ছে না। রেল ইঞ্জিন, কোচ কোথায়? কোথায় পাওয়ার কোচ, খাওয়ার গাড়ি। চালক, গার্ড ও অন্য আরও অনেক লোকবল প্রয়োজন। লোকবলের অভাব এমন পর্যায়ে গেছে যে প্রায়ই ছোট ছোট স্টেশন বন্ধ হচ্ছে।’

আন্তঃনগর ট্রেনের দাবিতে ইতোপূর্বে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে লংমার্চ, মানববন্ধন, রেলপথ অবরোধ এ ধরনের অনেক আন্দোলন হয়েছে। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়ন গবেষক আবদুল লতিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রেললাইন ও অবকাঠামো হওয়ার পরেও আন্তঃনগর ট্রেন না পাওয়াটা আমাদের জেলার নেতৃত্বের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই রেল যোগাযোগ না থাকায়, কষ্টকর জার্নির কারণে সরকারি ডাক্তারসহ অনেক প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা ঠাকুরগাঁওয়ে এসে থাকতে চান না। ফলে জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার মানুষ।’

রেলপথের দাবিতে নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওবায়দুল্লাহ মাসুদ বলেন, ‘লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ট্রেন থাকা সত্ত্বেও নতুন করে ট্রেন চালু হলো অথচ ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ের ট্রেনটি চালু হলো না।’

এদিকে রেলপথ আর রেল স্টেশন আধুনিকায়ন হলেও লোকবলের অভাবে আখানগর, রুহিয়া, কিসমত, নয়নবুরুজ, শিবগঞ্জ, ভোমরাদহ ও বাজনাহার স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। শাটল ট্রেন উদ্বোধনের পর ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশনে প্রতিদিন ২০টি শোভন চেয়ার টিকেট বিক্রি করা হলেও এখন এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৩২টি করা হয়েছে। এর মধ্যে শোভন চেয়ার ৩০টি ও প্রথম শ্রেণি এসি ২টি। এছাড়াও পঞ্চগড়ে ৩৫টি, রুহিয়ায় ১০টি ও পীরগঞ্জে ২৬টি শোভন শ্রেণির টিকেট বিক্রি করা হয়। রুহিয়া রেল স্টেশনের জন্য ১০টি টিকেট বরাদ্দ থাকলেও রুহিয়া ও পঞ্চগড়ের স্টেশন মাস্টার হিসেবে একই ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। স্টেশন মাস্টার পঞ্চগড়ে দায়িত্ব পালন করায় রুহিয়ার টিকেটগুলো যাত্রীরা যথাসময়ে পান না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘রাতে স্টেশন মাস্টার রুহিয়ার বাসায় এলে সেখান থেকে ওই টিকেট কেনেন যাত্রীরা।’ উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশনে প্রতিদিন গড়ে একশ টিকেট প্রয়োজন হয়। চাহিদার তুলনায় টিকেটের জোগান কম থাকায় প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে বচসা হয় বলে স্টেশন মাস্টার জানালেন। ঈদের সময় পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে।

এদিকে ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আখতারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নয় দিন আগেই আগাম টিকেট ছাড়া হয়। নির্দিষ্ট তারিখের তিন-চার দিন আগেই সব টিকেট বিক্রি হয়ে যায়।

রেল স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি হয় এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি জানান, কেউ যদি যাত্রী সেজে আগাম টিকেট কেটে রেখে পরে সেটা বেশি দামে বিক্রি করে তবে আমরা সেটা কীভাবে ঠেকাব? এ ব্যাপারে রেল স্টেশনের কেউ জড়িত আছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ব্যাপারটি অস্বীকার করেন।

রেল স্টেশন অপরিষ্কার থাকার বিষয়ে স্টেশন মাস্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, এখানে রেলওয়ের কোনও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। এ পদের জন্য কোনও বরাদ্দও নেই। পকেটের পয়সা খরচ করে কাউকে দিয়ে শুধু ঝাড়ু দেওয়া হয়। তার পাশে বসা অবসরপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার শামসুল আলম বলেন, ‘আগে প্রতিমাসে সুইপার বাবদ ১৫শ’ টাকা দেওয়া হতো, এখন সেটাও বন্ধ।’

এ লাইনে সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চালুর ব্যাপারে কোনও তথ্য তাদের কাছে আছে কিনা জানতে চাইলে স্টেশন মাস্টার বলেন, ‘এ ব্যাপারে কাগজ হাতে না পেলে কিছুই বলতে পারছি না। তাছাড়া সারা দেশে রেল ইঞ্জিন, রেল কোচ কম। চালক (লোকোমোটিভ মাস্টার) নেই। এমনকি ঢাকা রেল স্টেশন নতুন কোনও ট্রেন রিসিভ করতেও অক্ষম।’

একটি অসমর্থিত সূত্র মতে, আগামী নির্বাচনের আগেই দিনাজপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেন একতা ও দ্রুতযান দিনাজপুরের পরিবর্তে পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর হয়ে ঢাকা যাতায়াত করতে পারে। ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশনে কথা হয় যাত্রী শাহজাহান নেওয়াজের সঙ্গে। তিনি খবরটি জানতে পেরে বলেন, ‘আপাতত এটি হলে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার আংশিক পূরণ হবে। এর মধ্য দিয়ে যাত্রীদের নিরাপদে চলাচলের পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য পরিবহনেও অগ্রগতি হবে। কিন্তু সেটা নিয়েও সংশয় কাটছে না এখানকার মানুষের।’

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী