X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

পার পেয়ে যাচ্ছেন সোনাগাজীর আরেক ওসি কামাল?

রফিকুল ইসলাম, ফেনী
১৮ জুন ২০১৯, ১১:৪৪আপডেট : ১৮ জুন ২০১৯, ১৬:৪৯

কামাল হোসেন

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ফেনীর সোনাগাজী থানার তদানীন্তন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। তবে নুসরাত হত্যা মামলায় মূল আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টার সঙ্গে জড়িত তদানীন্তন ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন সোনাগাজী থানায় এখনও বহাল তবিয়তে ওসির দায়িত্বে আছেন। দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ হয়ে নুসরাত নিহত হওয়ার পর প্রথম যে হত্যামামলাটি সাজানো হয়, তাতে ওসি মোয়াজ্জেমের সঙ্গে যোগসাজশে মামলাটির বাদীর স্বাক্ষর জাল করে মূল আসামিদের বাদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই ওসির বিরুদ্ধে। তখন মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দিন মূল আসামিদের বাদ দিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচ নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরে এনে থানায় নির্যাতনের অভিযোগও আছে ওসি কামালের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, ‘নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনার দুই দিন পর (৮ এপ্রিল) ভোরে সোনাগাজী মডেল থানায় ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ফেনী পুলিশের পক্ষ থেকে একটি এজাহারের খসড়া তৈরি করে আমার কছে নিয়ে আসেন। সেই খসড়া এজাহারে আমি মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে প্রধান আসামি করে আট আসামির নাম পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করে বাকিদের অজ্ঞাতনামা হিসেবে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওইদিন বিকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়, পুলিশ মুখোশধারী চার জন এবং তাদের অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের আসামি করে আমাকে বাদী দেখিয়ে মামলাটি দায়ের করেছে। এতে আমি বিস্মিত হই। সঙ্গে সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেনের কাছে বিষয়টি জানতে চাই এবং মিথ্যা এজাহারের প্রতিবাদ জানাই।’

নোমান বলেন, ‘‘ওই এজাহারের সঙ্গে ৫৪ ধারায় পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (৯ এপ্রিল) তাদের সাত দিনের রিমান্ড চান ওসি কামাল হোসেন। পিবিআইতে মামলা হস্তান্তরের পর ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা কামাল হোসেন তখন গণমাধ্যমে ও আমাদের ডেকে দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজসহ ছয় আসামিকে তো থানা পুলিশই ধরে দিয়েছে। মামলার যা অগ্রগতি তা তো পুলিশেরই।’ এখন দেখি পিবিআই তদন্তে পুলিশের গ্রেফতারকৃত সেই পাঁচ জনই প্রমাণিত হলো নিরপরাধী। তাহলে পুলিশ এত চালবাজি কেন করলো? কার ইঙ্গিতে কাদের রক্ষায় এই কাজ করলো?’’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেনসহ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবার নাম না আসায় আমরা হতাশ হয়েছি।’

নুসরাত জাহান রাফি নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়ে দায়িত্ব পালনে তৎকালীন এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেনসহ পাঁচ পুলিশের অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি। পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমকে সদর দফতরে সংযুক্ত করলেও তার বিরুদ্ধে আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী এসপি ও ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা গেলেও ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। এ বিষয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সোনাগাজীর স্থানীয়রা।

এদিকে, ওসি কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার দিন (৬ এপ্রিল) ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার পরও মাদ্রাসার ছাত্র, পিয়ন, দারোয়ান ও ব্যাংকারসহ সাত জনকে আটক করেন ওসি কামাল। জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানা হাজতে তাদের ওপর বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন চালান তিনি। ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতেই এই কাজ করেছিলেন ওসি কামাল।

নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে নির্যাতনের শিকার হন নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দাখিল করা চার্জশিটে নাম না থাকায় আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। আরিফের বাবা আবুল হাসেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হত্যাকারীদের ইঙ্গিতে ঘটনার দিন আমার ছেলেকে ওসি কামাল পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য থানা হাজাতে কারেন্টের শক দিয়ে নির্যাতন করে। পরে সন্দেহভাজন আসামি দেখিয়ে আদালতে পাঠায় ও সাত দিনের রিমান্ড চায় ওসি কামাল। সে আমার ছেলেকে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমার ছেলের সহপাঠী নূর হোসেন, কেফায়েত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলামকে একইভাবে হয়রানি করেছে ওসি কামালসহ তার সহযোগী অসৎ পুলিশ সদস্যরা। আমরা এই পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর বিচার চাই।’

আদালতের নির্দেশে ছাড়া পাওয়া নুসরাতের আরেক সহপাঠী কেফায়েত উল্লাহর মা সালমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম ও ওসি কামালের অন্যায়-অবিচারের শিকার আমি ও আমার পরিবার। গত দুই মাস ঘুমাতে পারিনি। একদিকে এলাকার মেয়ে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার ভয়, অপরদিকে আমার নিষ্পাপ ছেলেকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে থানা পুলিশের নির্যাতন চালানোর যন্ত্রণা। এদের জন্য দীর্ঘ দুই মাস আমার নিরপরাধ ছেলেকে কারাবাস করতে হলো।’

এই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মূল উসকানিদাতা ওসি মোয়াজ্জেম এবং ওসি কামাল। পুলিশ ও তাদের গডফাদারদের বিরুদ্ধে কথা বলাটা আমাদের কাল হয়েছিল। এজন্য আমাদের মতো অনেককে ওসি কামাল গ্রেফতার করেছিল। তিন দিন থানা হাজতে আটক রাখে আমাদের পাঁচ জনকে। দফায় দফায় বৈদ্যুতিক শক, সুই ও লাঠি দিয়ে পেটানোসহ নানা কায়দায় নির্যাতন চালায় ওসি কামাল। ক্রসফায়ারের ভয়ও দেখায় কামাল ও ওসি মোয়াজ্জেম। আরও নির্যাতন করতে আমাদের রিমান্ড চায়। আল্লাহর রহমতে আর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মামলাটি পিবিআইয়ের হাতে যায়। মূল হত্যাকারীরা চিহ্নিত হয়ে এখন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে।’

তারা আরও বলেন, ‘কারাগার থেকে বের হয়ে দেখি ওসি মোয়াজ্জেমের প্রধান সহযোগী ওসি কামাল হোসেন এখনও একই পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনলাম তিনি এই ঘটনায় বাহবা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় পুরস্কারের জন্য নাকি আবেদন করেছেন তিনি। এটা আমাদের হতাশ করেছে। এই ধরনের পুলিশ অফিসার যতদিন থাকবেন ততদিন নুসরাতদের পুড়িয়ে মারা হবে, আর আমাদের মতো নিরপরাধীদের ফাঁসানোর চেষ্টা হবে।’

তারা বলেন, ‘আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রচলিত আইনে এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার, ওসি মোয়াজ্জেম ও কামাল হোসেনসহ অন্যান্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।’

সোনাগাজী প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি জাবেদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নুসরাত হত্যার পর সোনাগাজী মডেল থানায় ভিকটিমের বড় ভাই মাহমুদুল হাসানের স্বাক্ষর সাজিয়ে নিজেদের তৈরি করা এজাহারে মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলাটি এত দায়সারাভাবে সাজানো হয়েছিল যে এতে প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজের নামই বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরে ৯ এপ্রিল গণমাধ্যম ও নুসরাতের পরিবারের চাপে মামলার এজাহার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় পুলিশ।’

এই প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী, ‍হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটির অতিরিক্ত পরিচালক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ‘নুসরাতকে যৌন হয়রানি ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আষাঢ়ে গল্প বানানোর চেষ্টা করে এসপি জাহাঙ্গীর আলমের শেল্টারে থাকা সোনাগাজী থানা পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তা। ভুল তথ্য দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদেরও ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছে তারা। নুসরাত হত্যাচেষ্টা আড়াল হয়, এমন সব যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করে ওই দুই ওসি। নুসরাত হত্যাকারীদের সবার ফাঁসির পাশাপাশি এসপি, দুই ওসিসহ জড়িত পুলিশ সদস্যদেরও বিচার করতে হবে।’

সোনাগাজী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শাখাওয়াত উল হক বিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওসি কামাল হোসেন ফেনী জেলায় ঘুরেফিরে ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন, এই সুবাদে তার চলন-বলনে কিছুটা বেপরোয়া ভাব দেখা গেছে। নুসরাত হত্যার পর সোনাগাজী থানা পুলিশ প্রমাণ করেছে তারা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। দায়িত্বে অবহেলা করেছে। অপরাধ করেছে। সুতরাং আমরা তাদের যার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, তা তদন্ত করে বিচার চাই।’

এ বিষয় জানতে চাইলে ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন বলেন, এটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন বিষয়, তাই এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না। তবে তার দাবি, নুসরাত হত্যার ঘটনায় তিনি কোনও অবহেলা বা অপরাধ করেননি।

ফেনীর পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় আমি এখানে না থাকায় কার কী ভূমিকা, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা নেই। বিষয়টি পুলিশ হেড কোয়ার্টার দেখছে।’ পুলিশ হেড কোয়ার্টার যদি তার কাছে জানতে চায়, তাহলে পদ-পদবি অনুযায়ী কারও কোনও গাফিলতি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

/এফএস/ টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি