দক্ষিণাঞ্চলে ফুলের রাজধানী নামে খ্যাত যশোরের গদখালী। আর ফুলের দ্বিতীয় রাজধানী নামে খ্যাতি পেয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ। দেশের ফুলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার অর্ধেক পূরণ করছে এই দুই এলাকা। আসছে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ফুলচাষীরা দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছেন। 
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলার ছয় উপজেলায় ২০৮ হেক্টর জমিতে বিদেশি ফুল লিলিয়াম, জারবেরা, গ্লাডিওলাসসহ বিভিন্ন রকমের ফুলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলের আবাদ হয়েছে ৯০ হেক্টর জমিতে। কালীগঞ্জে চাষ হওয়া ফুলের মধ্যে রয়েছে- লিলিয়াম, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্র মল্লিকা, গাঁদাসহ বিভিন্ন রকমের ফুল। 
কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় ফুলচাষি ত্রিলোচনপুর গ্রামের এস এম টিপু সুলতান জানান, ২৭ বছর ধরে ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত তিনি। ত্রিলোচনপুরে ১৪ বিঘা জমিতে ফুলের আবাদ করছেন। এর মধ্যে দুই বিঘা জমিতে গোলাপ, ছয় বিঘায় জারবেরা, দুই বিঘায় গ্লাডিওলাস, দুই বিঘায় ভুট্টা ফুল ও দুই বিঘায় চন্দ্রমল্লিকা ফুল রয়েছে। ঢাকায় তার ফুলের ব্যবসা রয়েছে। তিনি শেরে বাংলা নগর ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের সহ-সভাপতি। 
টিপু সুলতান জানান, ‘সর্বপ্রথম গ্লাডিওলাস দিয়ে ফুল চাষ শুরু করি। এরপর জারবেরা ফুলের আবাদ করি। সর্বশেষ গত ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডের ফুল লিলিয়ামের চাষ করি। নেদারল্যান্ড থেকে ২৯ লাখ টাকা দিয়ে ৬০ হাজার পিস লিলিয়াম ফুলের বীজ আনি। জাহাজ ভাড়া সাড়ে তিন লাখ টাকাসহ অন্যান্য খরচ দিয়ে লিলিয়াম ফুলের জন্য আমার ব্যয় হয় প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। কিন্তু সময় মতো ফুল না উঠায় সে বছর আমি তেমনভাবে ফুল বিক্রি করতে পারিনি। গত দুই বছর আমি লিলিয়াম ফুল বিক্রি করেছি। ফুলের পরিচর্যা, সেচ, সার, ওষুধ, পরিবহনসহ প্রতিবছরে ব্যয় হয় ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকা। ব্যয় বাদে বছরে আমার লাভ হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা।’ তবে এই ফুলচাষি জানান, চলতি বছর তার জমিতে তেমন লিলিয়াম ফুল নেই। 
এ ব্যবসায়ী আরও জানান, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুলের ব্যবসা ভালো হয়। এ সময় ফুলের দাম ভালো পাওয়া যায়। তিনি পাইকারি হারে একটি লিলিয়াম ফুল ১০০ টাকা, জারবেরা ছয় থেকে ১৮ টাকা, গ্লাডিওলাস সাত থেকে ১৯ টাকা, গোলাপ দুই থেকে ১০ টাকা, চন্দ্র মল্লিকা এক থেকে তিন টাকা, ভুট্টা ফুল তিন থেকে সাত টাকা করে বিক্রি করে থাকেন। অবশ্য বাজার ভালো হলে দাম বেশি পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, চলতি বছরে ঝিনাইদহ জেলা থেকে ভালোবাসা ও মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। 
কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ডুমুরতলা গ্রামের ফুলচাষি মিজানুর রহমান জানান, ‘আমি মূলত গাঁদা ফুলের চাষ করি। চলতি বছর পাঁচ কাঠা জমিতে ফুলের আবাদ করেছি। দড়িতে ফুল গেঁথে ঝোপা তৈরি করা হয়। এক ঝোপায় সাড়ে ছয়শ থেকে সাতশ গাঁদা ফুল থাকে। ফুলের মূল্য কম থাকলে এক ঝোপা বিক্রি হয় ৩০ টাকায়। দাম বাড়লে সর্বোচ্চ সাতশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারি।’ 
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃপাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, ‘জেলায় চলতি বছর প্রায় ২০৮ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলায়ই ৯০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হয়েছে। উৎপাদন ব্যয় কম, আবার লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। জেলার গান্না ও কালীগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গা, তিল্লা, সিমলা, রোকনপুর, গোবরডাঙ্গা, পাতবিলা, পাইকপাড়া, তেলকূপ, গুটিয়ানী, কামালহাট, বিনোদপুর, দৌলতপুর, রাড়িপাড়া, মঙ্গলপৈতা, মনোহরপুর, ষাটবাড়িয়া, বেথুলী, রাখালগাছি, রঘুনাথপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ফুল চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গাঁদা ফুল চাষ হয় কালীগঞ্জে বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়। এ কারণে সবাই এখন এই এলাকাকে ফুলনগরী বলেই চেনেন।’ 
সরেজমিনে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেইন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকে শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন পরিবহনে করে নিয়ে আসছেন। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় লাল, সাদা আর হলুদ ফুলে ফুলে। 
সারাদেশের আড়তগুলোতে ফুল পাঠাতে আসা একাধিক ফুলচাষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সারা বছরই তারা ফুল বিক্রি করে থাকেন। তবে প্রতিবছর বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষের দিন, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবসে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এসময় দামও থাকে ভালো। ফুলচাষিরা নিজেরা না এসে সারা বছর তাদের ক্ষেতের ফুল চুক্তি অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরের ফুলের আড়তে পাঠিয়ে দেন। এসব স্থানের আড়তদাররা বিক্রির পর তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে ফুল চাষিদের টাকা খরচ করে ফুল বিক্রির জন্য কোথাও যাওয়া লাগে না। তারা মোবাইল কথা বলে বাজার দর ঠিকঠাক করে ফুল পাঠিয়ে থাকেন বলেও জানান কৃষকরা। 
এদিকে ফুলের আবাদকে কেন্দ্র করে কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা বাজারে গড়ে উঠেছে ফুলের জন্য আলাদা বাজার। ফুলচাষিরা সরাসরি এ বাজারে ফুল বিক্রি করতে আসেন।
বালিয়াডাঙ্গা গোপীনাথপুর গ্রামের ফুল ব্যবসায়ী শুকুর আলী জানান, তিনি ফুলচাষিদের কাছ থেকে সরাসরি গাঁদা ফুল কেনেন। বর্তমানে এক ঝোপা হলুদ গাঁদা ফুল ১০০ টাকা ও এক ঝোপা লাল গাঁদা ফুল ৮০ টাকা দরে কিনছেন। আর বিক্রি করেন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। অবশ্য বাজার ভালো হলে দাম আরও বেশি হয়। 
তিনি জানান, কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার আবাদ করা ফুল যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, খুলনা, যশোর, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর, নওগা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায়।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জাহিদুল করীম বলেন, ‘ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে কালীগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ফুলচাষ বেশি হয়। চলতি বছর ২০৮ হেক্টর জমিতে ৮০০ জন কৃষক ফুলের আবাদ করেছেন। এখানে বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে। আমরা কৃষি বিভাগ থেকে ফুলচাষিদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছি।’
