২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে দায়ের করা আলোচিত 'জঙ্গি-পুলিশ' সংঘর্ষের মামলার বিচার কাজ ১৭ বছরেও শুরু হয়নি। মামলায় ৫৯ আসামির মধ্যে শীর্ষ ১৩ জঙ্গি জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে প্রায় এক যুগ থেকে। জয়পুরহাট জেলা কারাগারে আছে ৮ জঙ্গি। আর জামিনে আছে ৩৮ আসামি। কারাগারে আটক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা থাকায় তাদের হাজিরা দিতে হয় সেসব মামলায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে দিন পড়লেও আসামির অনুপস্থিতির কারণে আদালতে অভিযোগ গঠন না হওয়ায় ১৭ বছর পরও বিচার কাজ শুরু হয়নি। অথচ ওই ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় ২০০৮ ও ২০১০ সালে ৬১ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। যার মধ্যে সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে একজনকে অব্যাহতি ও অন্য এক আসামি মৃত্যুবরণ করায় এখন ওই মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৫৯ জন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট রাতে ক্ষেতলালের আঞ্চলিক জেএমবি নেতা ও জয়পুরহাট কারাগারে আটক ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মন্তেজার রহমানের বাড়িতে গোপন বৈঠক বসে। সেখানে উপস্থিত হয় দেশের শীর্ষ জঙ্গি নেতারা। খবর পেয়ে জয়পুরহাট সদর ও ক্ষেতলাল থানার পুলিশ উত্তর মহেশপুর গ্রামের মন্তেজার রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে রাত প্রায় আড়াইটার দিকে তারা পালানোর চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে জয়পুরহাট সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল শফিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। জঙ্গিরা পুলিশের তিনটি শর্টগান, একটি ম্যাগাজিন ও ওয়াকিটকি লুট করে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় সদর থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক এস আই শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে পরের দিন ১৫ আগস্ট ক্ষেতলাল থানায় ৩৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ঘটনার রাতেই পুলিশ ২০ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। ঘটনার দুদিন পর ঘটনাস্থল ও আশে পাশের এলাকা থেকে পুলিশ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করলেও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে ব্যর্থ হয়।
পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দিনাজপুর জোনের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ পরিদর্শক জালাল উদ্দীন তদন্ত করে ২০০৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ৬১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অপর দিকে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার হওয়ায় ওই ৬১ জনের বিরুদ্ধে পৃথক আরও দুটি মামলা হয়। দিনাজপুর জোনের সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আহসান উল কবীর মামলা দুটি তদন্ত করে গত ২০১০ সালের ২৫ মে ওই ৬১ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট মামলা দায়ের হওয়ার পর বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালত থেকে ১৩ জন আসামি জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন। পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে দেখা গেছে, ওই সব পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে দেশের একাধিক জেলায় বিস্ফোরক আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
আসামি পক্ষের আইনজীবী হেনা কবীর জানান, মামলা তিনটি জয়পুরহাট অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেন যে, দীর্ঘদিন থেকে বেশ কয়েকজন আসামি জামিনে গিয়ে পলাতক থাকার পাশাপাশি জয়পুরহাটে গ্রেফতার হওয়া আসামিদের নামেও দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা রয়েছে। ওইসব মামলায় বিভিন্ন জেলার আদালতে তাদের হাজিরার জন্য যেতে হয়। ফলে জয়পুরহাটের আলোচিত এই মামলায় হাজিরার দিন অনুপস্থিত থাকেন অনেক আসামি। এতে আইনগত জটিলতায় মামলাটির বিচার কাজ বিলম্ব ঘটায় ন্যায় বিচার থেকে আসামিপক্ষ বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি আইনজীবী (পিপি) নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল জানান, মামলার ১৩ শীর্ষ আসামি আদালত থেকে প্রায় একযুগ আগে জামিন নিয়ে পলাতক আছেন। তাদের বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তারা গ্রেফতার হয়ে এই মামলায় বিচারের সম্মুখীন হননি। এছাড়া কারাগারে আটক অন্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন জেলায় মামলা থাকায় তাদের অনেককে জয়পুরহাট আদালতে সময়মতো হাজির করা যাচ্ছে না। আইনের বিধান হলো, একজন আসামির অনুপস্থিতিতেও মামলার চার্জ গঠন করা যাবে না। ফলে আসামিদের হাজিরা নিশ্চিত করতে না পারার আইনগত জটিলতার কারণেই ঘটনার ১৭ বছরেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচার কাজ শুরু করা যায়নি।