X
বুধবার, ২২ মে ২০২৪
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পঞ্চগড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনটি চিতাবাঘ, আতঙ্কে নির্ঘুম গ্রামবাসী

পঞ্চগড় প্রতিনিধি
২০ আগস্ট ২০২০, ২২:৫৮আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২০, ২৩:৫৯

পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী গ্রামে চিতাবাঘের পায়ের ছাপ

একটি চিতাবাঘ ও তার দুই ছানার হামলার আশঙ্কায় পঞ্চগড়ে এখন দিনে-রাতে আতঙ্কিত কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রায় এক মাস ধরে বাচ্চাসহ বাঘগুলো ঘুরছে পঞ্চগড় সদর উপজেলা ও তেতুঁলিয়া উপজেলার সাতমেরা ও দেবনগর ইউনিয়নের মুহুরিজোত, সাহেবীজোত, ঊষাপাড়া ও বাদিয়াগজ গ্রামে। এগুলো সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে এসেছে। এরইমধ্যে অনেকের চোখে পড়েছে চিতাবাঘটি। বাঘের পেটে গেছে গৃহস্থের গরু-ছাগল, রাস্তার কুকুর। পাওয়া গেছে বাঘের পায়ের ছাপ। বাঘ ঢোকার খবর নিশ্চিত হয়ে জেলা প্রশাসন গ্রামগুলোতে সতর্ক প্রহরা বসিয়েছে। আর চিতাবাঘগুলো জীবিত ধরতে জেলা বন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে রাত জেগে বাড়িঘরে পাহারা বসিয়েছেন গ্রামের মানুষ। আতঙ্কিত গ্রামবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে ওই এলাকায় চলছে প্রশিক্ষিত বনকর্মীদের অভিযান। এসব বনকর্মী সেখানে গিয়ে এখন পর্যন্ত বাঘ দেখতে না পেলেও বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সামাজিক বন বিভাগের উদ্যোগে ওই এলাকায় মাইকিং করে গ্রামবাসীকে রাতে সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বাঘের আনাগোনার কথা শুনে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা ওই এলাকা পরিদর্শন করেন এবং ঘটনার সত্যতা পান।

সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী সাহেবীজোত নামের একটি গ্রামে চার একর জায়গাজুড়ে একটি পুরনো চা বাগান রয়েছে। সংস্কারের অভাবে এই চা বাগানের গাছগুলো এখন এক মানুষ লম্বা। এই ঘন চা বাগানের বাইরে রয়েছে আরও জঙ্গল। স্থানীয়দের ধারণা, এখানেই দিনেরবেলা লুকিয়ে থাকে ছানাসহ চিতাবাঘ। এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই চা বাগানের আশপাশে শত শত উৎসুক মানুষের ভিড়। দূরদূরান্ত থেকে তারা বাঘ দেখতে এসেছেন। কেউ কেউ চা বাগানের ভেতরে ঢুকেও বাঘের দেখা পাওয়া চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্থানে বাঘ ধরতে ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় কয়েকজন লোক জানায়, মাসখানেক আগে একটি চিতাবাঘ তার দুটি বাচ্চাসহ সীমান্তবর্তী একটি ব্রিজের নিচ দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে—এমন কথা সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনদের অবহিত করেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। তবে এ তথ্য বিজিবিকে জানায়নি বিএসএফ। বিষয়টি এলাকায় চাউর হলে সবার মধ্যে বাঘ নিয়ে আতঙ্ক শুরু হয়। এরপর ওই এলাকার কেউ কেউ আকারে লম্বা ও গায়ে কালো গোল ছাপ থাকা বাঘ ওই চা বাগানের পাশের জঙ্গলে দেখতে পান। তাদের ধারণা এগুলো চিতাবাঘ। তারা বাঘের সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করছেন।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, দুটি বড় ও তিনটি বাচ্চা বাঘ দেখেছেন। তবে অন্য আর কারও কাছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

অতি উৎসাহীরা একটি জঙ্গলের নিচ দিয়ে উঁকি মেরে বাঘ খুঁজছেন।

আবার, একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসী বলেন, ‘বিজিবি তিনটা বাঘ দেখেছে সে কথা আমাদের বলেছে। বাঘ তো আর বিজিবির অনুমতি নিয়া ঢোকে নাই। তাই দুই তিনটা বেশি বাঘও তো আসতে পারে। তবে বাঘ দেখা গেছে এ গ্রামে। ওগুলো চিতাবাঘ।’

স্থানীয় গ্রামবাসীর দাবি, দিনের বেলা জঙ্গলে না হয় চা বাগানের ভেতরে চিতাবাঘগুলো ঘাপটি মেরে থাকে, রাত হলেই বের হয়ে গ্রামের দিকে চলে আসে। গত এক সপ্তাহ থেকে বাঘের আনাগোনা আরও বেড়ে গেছে। তাই প্রয়োজন ছাড়া কেউ হাট-বাজারে যাচ্ছেন না। গেলেও দলবেঁধে যাচ্ছেন। এখন রাতে শান্তিতে ঘুমাতেও পারছেন না তারা। কোনও মানুষের ওপর এখনও আক্রমণ হয় নাই। কিন্তু, এই বাঘ তো গাছেও চড়তে পারে। তাই ভয় আরও বেশি। এখন প্রতিটি বাড়িতে বড় টর্চলাইট রাখা হয়েছে। বাঘের ভয়ে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন গ্রামের মানুষ।

দেবনগড় ইউনিয়নের ঊষাপাড়া গ্রামের আবুল কালাম জানান, বুধবার বিকেলে আমার একটি গরুকে বাঘ গলায় কামড়ে ধরে হত্যা করে। আমি নিজেই চা বাগানে চিতাবাঘটিকে দেখেছি এবং সে সময় আমার চিৎকারে লোকজন ছুটে আসে। অন্যরাও বাঘ দেখেছে।বাঘটি আমার দিকে তেড়ে আসছিল, কিন্তু চা বাগানের ডালপালার কারণে কাছে আসার আগেই আমি দৌড়ে বাড়ি চলে আসি। আমার ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার গরু মেরে ফেলে বাঘটি। এর আগে আরেকজনের আরেকটি ছাগলও খেয়েছে বাঘটি।

মানুষের চেয়ে উঁচু পরিত্যক্ত চা বাগানের ভেতরে দলবেঁধে উৎসুক মানুষ ঢুকে খুঁজছেন বাঘ।

সাহেবীজোত গ্রামের হাজিবউদ্দিন নামের একজন জানান, আমরা কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ বাঘ আতঙ্কে ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। এই এলাকায় বেশ কয়েকবার আমরা বাঘের আনাগোনা দেখেছি। বাঘ তাড়ানো বা ধরার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

মুহুরীজোতা গ্রামের রুবেল রানা জানান, আমাদের এলাকায় এখনও বেশ কিছু এলাকায় জঙ্গলসহ পুরোনো চা বাগান রয়েছে। বাঘ এলে এ এলাকায় ঘাপটি মেরে থাকে। ভয়ে আমরা স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছি না। সন্ধ্যার পর কেউ বের হয় না।

গ্রামবাসীর এমন দাবির মুখে বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফ হোসেন, পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক শাহীনুজ্জামান, সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান, পঞ্চগড়ের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুল হাইসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

পঞ্চগড় ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুল হাই জানান, প্রধান বন সংরক্ষকের নির্দেশে ঢাকা থেকে আসা ভেটেরেনারি সার্জনসহ ৪ সদস্যের একটি দল ও আমাদের স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে বাঘ ধরার কাজ শুরু হয়েছে। 

বাঘ খুঁজতে বাচ্চাসহ পাবলিক ঢুকে গেছে পরিত্যক্ত চা বাগানে। সেখানেই পাওয়া গেছে সত্যিকারের বাঘের ছাপ।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফ হোসেন জানান, কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এবং মারা যাওয়া কয়েকটি গরুর মালিকের দাবি ও বাঘের পায়ের ছাপ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এ এলাকায় বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক এ বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। এছাড়া আমরা বন বিভাগের সমন্বয়ে বাঘটিকে ধরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করেছি। স্থানীয়দের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি।

এছাড়া বাঘের আক্রমণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।  

দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানান, এখানে বাঘ একটি গরুকে হত্যা করেছে। জেলা বন কর্মকর্তাকে বাঘ ধরার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে ৪ সদস্যের একটি অভিজ্ঞ টিম পাঠানো হয়েছে। তবে বাঘগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বাঘগুলোর অবস্থান নিশ্চিত হয়ে বাঘগুলোকে জীবিত অবস্থায় ধরতে।

চা বাগানের বাইরে বাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছে বাঘের কথা শুনে।

উল্লেখ্য, এই এলাকায় এক দশকে আরও অন্তত দুইবার চিতাবাঘের আক্রমণ হয়েছিল। তখনও গ্রামের মানুষ আতঙ্কিত ছিল। পরে একবার বাঘ মেরে ও আরেকবার বাঘ তাড়িয়ে এলাকায় স্বস্তি ফেরে। এই সীমান্তের ওপারে হিমালয়ের পাদদেশ হওয়ায় সেখানকার জঙ্গলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিতাবাঘ আছে। সেখান থেকেই মাঝে মাঝে এই সীমান্তবর্তী গ্রামে বাঘের আনাগোনা দেখা দেয়।

/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসবলের দেশ হারিয়ে দিলো বাংলাদেশকে
বেসবলের দেশ হারিয়ে দিলো বাংলাদেশকে
দুইদিন বিঘ্নিত হতে পারে ডেসকোর প্রিপেইড মিটার রিচার্জ
দুইদিন বিঘ্নিত হতে পারে ডেসকোর প্রিপেইড মিটার রিচার্জ
শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সামনে অজ্ঞাত হামলায় ছাত্রদলের দুই নেতা আহত
শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সামনে অজ্ঞাত হামলায় ছাত্রদলের দুই নেতা আহত
মৎস্যজীবী লীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
মৎস্যজীবী লীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
সর্বাধিক পঠিত
১০০ লিচু ১০০০ টাকা, তবু দুশ্চিন্তায় এই গ্রামের চাষিরা
১০০ লিচু ১০০০ টাকা, তবু দুশ্চিন্তায় এই গ্রামের চাষিরা
বিসিএস বাণিজ্য ক্যাডার সংস্কারে নতুন আদেশ
বিসিএস বাণিজ্য ক্যাডার সংস্কারে নতুন আদেশ
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সহিংসতার দুটি মামলা থেকে খালাস পেলেন ইমরান খান
সহিংসতার দুটি মামলা থেকে খালাস পেলেন ইমরান খান
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র