X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

অবিবাহিত নারীর নামে মাতৃত্বকালীন ভাতা আত্মসাৎ!

হেদায়েৎ হোসেন মোল্লা, খুলনা
৩০ আগস্ট ২০২০, ২১:২২আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২০, ২৩:০৭

খুলনায় মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীদের তালিকায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় চারজনের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করা হয়।  
কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচির আওতায় খুলনা সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৫০ জন দরিদ্র দুস্থ কর্মজীবী মাকে মাতৃত্বকালীন ভাতার বরাদ্দ দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর। তবে এ ভাতা তাদের বদলে পাচ্ছেন এক অবিবাহিত নারী, বড় বড় সন্তান থাকা একাধিক মা, ওয়ার্ডের বাইরে থাকা বেশ কিছু নারী। এদের অনেকেই আবার কর্মজীবীও নন। অনিয়ম শুধু এখানেই নয় এ ভাতা দেওয়ার কথা বলে আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে নেওয়া হয়েছে জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে আর টাকা ওঠানোর সময়ও অনেকের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে অর্ধেকের বেশি টাকা। আবার একজন ভাতা গ্রহণ করেছেন অন্য জনের ছবি ব্যবহার করে। এসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ওই ওয়ার্ডের জবা নারী কল্যাণ সমিতির সভানেত্রী বিনু ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি ৬নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

মহিলা বিষয়ক অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কেসিসির শুধু ৬ নম্বর ওয়ার্ডে গর্ভবতী ৫০ জন অসহায় দরিদ্র নারীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। অধিদফতর থেকে দরিদ্র এই ভাতা গ্রহীতার তালিকা চাওয়া হয় জবা নারী কল্যাণ সমিতির কাছে। সে অনুযায়ী এ সংগঠনের সভানেত্রী বিনু ইসলাম ৫০ জন নারীর ছবিসহ নামের তালিকা জমা দেন। ওই তালিকা যাচাই শেষে অধিদফতরের খুলনা শাখার উপ-পরিচালক নার্গিস ফাতেমা জামিন ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এ তালিকা অনুসারেই ভাতা গ্রহীতারা প্রতি মাসে ৮শ’ টাকা করে পাচ্ছেন। তবে সরকারের আরও কিছু সংস্থার মতো প্রতি মাসে ভাতা প্রদান না করে ভাতা গ্রহীতাকে এককালীন বার্ষিক ৯ হাজার ৬শ’ টাকা দেওয়া হচ্ছে। অগ্রণী ব্যাংক দৌলতপুর শাখার মাধ্যমে এ বছর তারা এ টাকা পেয়েছেন, পাবেন আরও দু’বছর। অর্থাৎ ভাতা গ্রহীতারা আরও দু’কিস্তির টাকা পাবেন।

তবে অভিযোগ রয়েছে, ভাতা গ্রহীতাদের এ তালিকা তৈরির শুরু থেকেই চলে অনিয়ম। মহিলা বিষয়ক অধিদফতরে যে তালিকা দেওয়া হয় তাতে দরিদ্র নারীদের বদলে অধিংকাশ নামই এসেছে ধনী ও সচ্ছল পরিবারের।

অঞ্জনা সরকার। এই নারীর অভিযোগ তার স্বামীর নাম ব্যবহার করে তার অবিবাহিত বোনকে বিবাহিত দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ভাতা ওঠানো হচ্ছে। এতে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।

অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচির আওতায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়ার জন্য স্থানীয় নারী সংস্থার প্রধান হিসেবে বিনু ইসলাম নামে ওই মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রীর কাছে তালিকা চাওয়া হয়। তবে এ তালিকায় নাম উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি শুরু থেকেই অনিয়ম করে আসছেন। ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতি ভাতা গ্রহীতা ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলবেন এমন সরকারি নিয়ম থাকলেও মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় নাম তুলে দেওয়ার শর্তে ভাতা গ্রহীতাদের কাছে এক হাজার টাকা করে নেন বিনু। এছাড়াও তালিকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাতা গ্রহীতাদের মোবাইল নম্বর দেওয়ার বিধান থাকলেও একজন ছাড়া আর কারও মোবাইল ফোন নম্বর তিনি তালিকায় দেননি। অথচ ভাতা গ্রহীতাদের প্রায় সবারই মোবাইল ফোন রয়েছে।

ভাতা তোলার সময়েও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন ভাতাগ্রহীতারা।  ব্যাংক থেকে তারা ৯ হাজার ৬শ' টাকা চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করলেও নিয়ে যেতে পেরেছেন মাত্র ৩ হাজার টাকা। বাকি ৬ হাজার ৬শ’ টাকা ব্যাংকের বাইরে দাঁড়িয়ে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বিনু ইসলামের লোক জোর করে কেড়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভাতাগ্রহীতারা। এই জবরদস্তির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সভানেত্রীসহ তার আশ্রয়ে থাকা লোকেরা।

মাতৃত্বকালীন ভাতাগ্রহীতা (৩৫ নং তালিকাভুক্ত সদস্য) ডালিয়া বলেন, চেকের মাধ্যমে ৯ হাজার ৬০০ টাকা উত্তোলন করি, আমাদের দিয়েই চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হয়। তবে ব্যাংকের বাইরে বিনুর লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাংক হতে বের হওয়ার পরই আমাদের হাতে তিন হাজার দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে নেয়। এছাড়া প্রথমে ফরম বাবদ এক হাজার টাকা নেয়। শুধু ডালিয়া একা নন, এমন আরও ১৫/২০ জন ভাতা গ্রহীতা একই অভিযোগ করেন।

তাদের অভিযোগ অনুযায়ী, ৫০ জন ভাতাগ্রহীতার কাছ কাছ থেকে বিনু ও তার লোকেরা ৩ লাখ ৫০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আবার যে কুমারী নারীকে বিবাহিত দেখিয়েছেন সে নামের ভাতা পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন বিনু এমন অভিযোগও রয়েছে।

যে কুমারী নারীকে বিবাহিত দেখানো হয়েছে অধিদপ্তরের নথি অনুযায়ী তার স্বামীর নাম দেখানো হয়েছে শ্যামল সরকার। তবে বাস্তবে শ্যামল সরকারের স্ত্রীর নাম অঞ্জনা সরকার। নাম উল্লেখ করা অবিবাহিতা নারী অঞ্জনার ছোট বোন। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, শ্যামল সরকারের স্ত্রী অঞ্জনা সরকার।

প্রতারণার অভিযোগ তুলে অঞ্জনা সরকার বলেন, আমার স্বামী একজন ইজিবাইকচালক। করোনা সংকটে আমরা ত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদের ছবি ও আইডি কার্ডের ফটোকপি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ মহিলা নেত্রী বিনু ইসলামের কাছে জমা দেই। করোনার সময় জমা দেওয়া ওই ছবি নিয়ে এ প্রতারণা করা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বিনু আমাদের ছবি ব্যবহার করে প্রতারণার পাশাপাশি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত করেছেন। একজন কুমারী অবিবাহিত মেয়েকে গর্ভবতী দেখিয়ে টাকা এনে তা আত্মসাৎ করেছেন। ভাতা গ্রহণ না করেও আমরা এখন দোষের ভাগীদার।

তিনি আরও বলেন, করোনা সংকটের সময়ে ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের ত্রাণ না দিয়ে বলা য়েছেন আমরা নাকি বড়লোক। তাহলে এখন আমাদের নামে ত্রাণ এনে তোমরা খাচ্ছো কেন বাপু? তোমরা তাহলে কী লোক?

যে অবিবাহিত নারীর নাম ওই তালিকায় দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে তিনি মোবাইল ফোনে জানান, তিনি একজন বেসরকারি চাকরীজীবী এবং কুমারী। মাতৃত্বকালীন ভাতার ব্যাপারে কিছুই জানেন না।

অন্যদিকে, শেখ ইছহাক আলীর স্ত্রী নাদিরা বেগম ও ফরিদ খানের স্ত্রী নাহিদা আক্তার নদী- আপন দু’বোন। তাদের বাড়ি বিএল কলেজ রোডের মোল্লা বাড়ি। সম্প্রতি তাদের কোনও সন্তান হয়নি। তাদের সন্তানরা বেশ বড় হয়েছে। এ অবস্থায় তারা দু’জনই পেয়েছেন মাতৃত্বকালীন ভাতা।

এই ভাতা প্রযোজ্য ছিল কেবলমাত্র খুলনা সিটি করপোরেশনের ৬নং ওয়ার্ডের জন্য। তবে এই ওয়ার্ড থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করেও সালমা খাতুন নামে আরেক নারী পেয়েছেন ওই ওয়ার্ডের মাতৃত্বকালীন ভাতা। তিনি খুলনা সদর থানার টুটপাড়া মিয়াপাড়া ২নং গলির বাসিন্দা তানজাম আলীর স্ত্রী।

নিয়ম হচ্ছে, স্ব স্ব ওয়ার্ডের দরিদ্র মায়েরা অগ্রাধীকার ভিত্তিতে মাতৃত্বকালীন ভাতা পাবেন। কিন্তু ওয়ার্ডে দরিদ্র মায়ের সংখ্যা অনেক থাকার পরও এলাকার বাইরে গিয়ে পছন্দসই লোকদের ভাতা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে আরও পাঁচজন অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়েও মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছেন। এছাড়া ভুয়া আইডি কার্ডের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ভাতা গ্রহীতাদের ক্ষেত্রে। এর দু’জন হলেন রুনা বেগম ও খুকুমনি। এদের ভাতার তালিকা নম্বর ৪২ ও ৪৩।

৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদ আলী মজনু বলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী হয়ে বিনু ইসলাম মাতৃত্বকালীন ভাতার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাই বিষয়টি তদন্ত করে দোষীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ প্রিন্স বলেন, মাতৃত্বকালীন ভাতা আত্মসাতের বিষয়ে তার কাছে ২/৩ জন ভাতাভোগী অভিযোগ করেন। এদের দাবি, তারা অধিদফতর থেকে দেওয়া টাকা পুরোটা পাননি। ৯৬০০ টাকার পরিবর্তে তাদের দেওয়া হয়েছে ৩/৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

খুলনার মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপ পরিচালক নার্গিস ফাতেমা জামিন বলেন, অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে ৩ জনের ভাতা স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে জবা সমিতির লাইসেন্সও বাতিল করা হবে।

৬নং ওয়ার্ড সিডিসির সাবেক সভানেত্রী রেখা রাণী ধর বলেন, বর্তমান সভানেত্রী বিনু ইসলাম জবা নারী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে ৬নং ওয়ার্ডের জন্য ৫০ জনের মাতৃত্বকালীন দুগ্ধ ভাতা পেয়েছিলেন। তিনি যে তালিকা করেছেন তাতে প্রচুর অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি করা হয়েছে। কুমারী মেয়েকে বিবাহিত, বন্ধ্যা নারীকে গর্ভবতী, বড় বড় সন্তানের মাকে দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এগুলোর বিচার হতে হবে।

জবা মহিলা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বিনু ইসলাম দাবি করেন, মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকা করার সময় ব্যস্ততার কারণে ৪টি নাম ভুলক্রমে লেখা হয়েছে। ওই ৪টি নাম বাদ দেওয়ার জন্য গত ১৫ জুলাই তিনি মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপ পরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন।

তিনি বলেন, পূর্ণিমা সরকারসহ সকল তালিকাভুক্ত মায়েরা প্রথম কিস্তির ৯ হাজার ৬শ’ টাকা এককালীন পেয়েছেন। বাকি আরও দুটি কিস্তির টাকা তারা পাবেন।

ভাতাভোগীদের অনেকেই পুরোট টাকা পাননি এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত সবাইকে পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে। যারা বলেছে কম দেওয়া হয়েছে তারা মিথ্যা বলেছে বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি বলেন, তালিকা প্রণয়ন তো আর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই আমার লোক দিয়ে তালিকা করি। কিন্তু পরে অবশ্য দেখি ৩/৪ জনের নামের তালিকা ভুল করা হয়েছে। কুমারী মেয়েকেও মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় আনা হয়েছে। এমন ভুল জানতে পেরে আমি সঙ্গে সঙ্গে অধিদফতর বরাবর সংশোধনের জন্য আবেদন করি এবং এ আবেদনের ভিত্তিতে এই ভাতা গ্রহীতাদের নাম তালিকা হতে বাদ দেওয়া হয়।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
অননুমোদিত স্টিকারে ৩৬৩ মামলা, দুই হাজার গাড়ি ডাম্পিং: ট্রাফিক পুলিশ
অননুমোদিত স্টিকারে ৩৬৩ মামলা, দুই হাজার গাড়ি ডাম্পিং: ট্রাফিক পুলিশ
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
আ. লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা সোমবার
আ. লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা সোমবার
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি