পড়াশুনা শেষ করে সবাই যখন চাকরির পেছনে ছোটে; তখন চাকরি ছেড়ে নিজের ভাগ্য ফেরানোর পাশাপাশি অন্যের জন্য তৈরি করেছেন কর্মসংস্থান। প্রচণ্ড অধ্যবসায় এবং একাগ্রতা থাকলে যে কোনও অবস্থা থেকেই উন্নতি করা যে সম্ভব ঠিক তাই করে দেখিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রফিকুল ইসলাম। দেশি-বিদেশি ফলের বাগান গড়ে হয়েছেন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি বরেন্দ্র অঞ্চলে সবুজায়ন সৃষ্টিতেও রাখছেন ভূমিকা।
২০০৫ সালে পড়াশুনা শেষ করে স্থানীয় একটি কলেজে শুরু করেন চাকরি জীবন। নিয়মিত বেতনভাতা না পাওয়ায় জীবন নিয়ে ছিলেন হতাশ। কিন্তু হাল ছাড়েননি। মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে রফিকুল বদলেছেন নিজের ভাগ্য।
সরেজমিন, রফিকুলের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, থোকায় থোকায় দুলছে পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগন ও বিভিন্ন জাতের আম। এ সময় ‘বাংলা ট্রিবিউন’ প্রতিনিধিকে রফিকুল ইসলাম জানান, ‘বেকারত্ব দূর করতে ২০০৫ সালে ৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে গড়ে তোলেন পেয়ারা বাগান। পরে পেয়ারা চাষে সফল হলে একে একে গড়ে তোলেন মাল্টা, ড্রাগন, ১৮ জাতের আমসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফলের মিশ্র বাগান। গত ১০/১২ বছরে তাই বিস্তৃত হয়েছে তার বাগান ও ব্যবসায়। বর্তমানে জেলার গোমস্তাপুর ও নাচোলের বরেন্দ্র এলাকায় ৮৪০ বিঘা জমিতে ফলের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন রফিকুল ইসলাম। যা থেকে বছরে তার আয় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। বর্তমানে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে তার বাগানে কাজ করছেন প্রায় ২৫০ জন নারী-পুরুষ। যারা তার বাগানে কাজ করে এখন স্বাবলম্বী।’
ফলের বাগান গড়েই থেমে থাকেননি তরুণ এই উদ্যোক্তা। আমদানি নির্ভরতা কমাতে বরেন্দ্র’র রুক্ষ মাটিতে বিদেশি এবং বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় ফলের চাষ সম্প্রসারণে করছেন গবেষণাও। এরই মধ্যে সাড়ে চার বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন দেশি বিলুপ্ত প্রায় শরীফা ফলের বাগান। কাজ করছেন কমলা, রাম্বুটান, জাপানি পার্সিমনসহ আরও নানা দেশি-বিদেশি ফল নিয়ে। সফল এই কৃষি উদ্যোক্তা দেশি-বিদেশি ফলের পাশাপাশি কাজ করছেন মৎস্য ও গরুর খামার নিয়েও। লক্ষ্য দেশের মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে আগামীতে একটি সমন্বিত খামার গড়ে তোলার।’
তিনি আরও জানান, ‘যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে চাকরি ছেড়ে ফল বাগান গড়ে তুলেছিলেন আজ তা সফল।’ সেই লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে নিজে লাভবান হওয়া, বরেন্দ্র অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সবুজ বনায়ন। তিনি বলেন, ‘তার এই সাফল্যে এখন মুগ্ধ স্থানীয়রাও। তার দেখাদেখি এখন বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এগিয়ে এসেছেন ফলের বাগান করতে। তারাও রফিকুলের কাছ থেকে পরামর্শ ও ভালো চারা সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছেন নানা জাতের ফলের বাগান। হয়েছেন স্বাবলম্বী। সৃষ্টি করেছেন বহু মানুষের কর্মসংস্থানও।
রফিকুলের মাল্টা বাগানে কথা হয় বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। তারা জানান, ‘কিছুদিন আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে একবার শুধুমাত্র আমন ধান ছাড়া তেমন কোনও ফসল হতো না। তাও যে বছর ভালো বৃষ্টিপাত হতো সে বছর ধান হতো, না হলে হতো না। এতে আমরা বছরে ধান মৌসুমে মাসখানেক কাজ করতে পারতাম। তারপর সারা বছরই আমাদের কাটতো কাজ ছাড়াই। এতে আমরা চরম দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করতাম। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা ঠিকমতো সংসার চালাতে পারতাম না। কিন্তু, এখন আমরা সারাবছর কাজ করতে পারি বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে ওঠা এসব ফলের বাগানে। এতে আমাদের আয় রোজগার বেশ ভালো হয়। আমাদের এখন আর অভাব নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন আমরা বেশ সুখে আছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনাও করাতে পারছি। শুধু তাই নয়; পুরুষদের পাশাপাশি এ অঞ্চলের নারীরাও এসব বাগানে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।’
কথা হয় নারী শ্রমিক মাতুয়ারার সাথে। তিনি জানান, ‘এখানে কাজ করে আমি মাসে ১০ হাজার টাকা রোজগার করি। এই টাকা দিয়ে আমি আমার পরিবারের সচ্ছলতা ফিরে পেয়েছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করাতে পারছি। আমার স্বামীর পাশাপাশি আমার এই আয়ের টাকাটা এখন সংসারে বাড়তি আয়। যা দিয়ে আমরা আগামীতে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখি।’
আরেক শ্রমিক জাহেদুর রহমান জানান, ‘আগে আমি বছরে একবার ধান চাষের কাজ করতাম। এখন রফিকুলের ফলের বাগানে সারাবছর কাজ করি। আমার মতো এই বাগানে আরও প্রায় ২৫০ জন নারী-পুরুষ কাজ করে। এই বাগানে কাজ করে আমরা এখন সবাই ভালো আছি। আমাদের সারা বছর কর্মসংস্থান হয়েছে।’
শুধু রফিকুলের বাগানই নয়; সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে ওঠা এসব ফলের বাগানে এ অঞ্চলের হাজার হাজার অসহায়-গরিব মানুষদের বেকারত্ব যেমন দূর হয়েছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানও।
গোমস্তাপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ সফিকুল ইসলাম জানান, ‘রফিকুল আমার প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক ছিলেন। চাকরি ছেড়ে রফিকুলের এই উদ্যোগ এবং সফলতা অন্য বেকার যুবকদের কাছে অনুকরণীয়। তাই আমি বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের উদ্দেশে বলবো, শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং তাকে অনুকরণ করেও জীবনে সফলতা পাওয়া সম্ভব।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তরুণ এই উদ্যোক্তা শুধু নিজের স্বপ্নপূরণই নয়; বেকার ও দরিদ্র মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বরেন্দ্র এলাকায় সবুজায়ন সৃষ্টিতেও রাখছেন ভূমিকা। যা অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে অন্য শিক্ষিত ও বেকার যুবকদেরও। কৃষিকাজ করে যে নিজেকে এগিয়ে নেওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি এখন স্থানীয় বেকারদের অনুপ্রেরণা। তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেকেই। তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত যুবকরা এ ধরনের ফলের বাগান করতে এগিয়ে এলে উন্নয়ন ঘটবে এ খাতে। কমবে বেকার সমস্যাও।’
তিনি আরও জানান, ‘এমন উদ্যোক্তা তৈরিতে নিরলস কাজ করছে কৃষি বিভাগ। তরুণ, উদ্যমী ও আগ্রহী যুবকরা এ পেশায় এগিয়ে এলে কৃষি বিভাগ তাদের সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছে। বিশেষ করে করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন, তাদের উদ্দেশে বলবো স্বল্প পরিসরে হলেও; তারা এই ধরনের পেশায় আসলে আগামীতে ভালো কিছু হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হবেন তারা।’
রফিকুল ইসলাম সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে ‘ফলদ বৃক্ষ মেলায়’ উপজেলা পর্যায়ে সেরা কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে ক্রেস্ট ও সম্মাননা লাভ করেন। স্বপ্ন দেখেন সফল চাষিদের হাত ধরে একদিন গড়ে উঠবে বেকারমুক্ত বাংলাদেশ।